বন্ধু নির্বাচনে ইসলামের নির্দেশনা

মো. আমিনুল ইসলাম

বন্ধুত্ব মানুষের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বন্ধু ছাড়া মানুষের জীবন অচল। প্রতিটি মানুষের জীবনে কেউ না কেউ তার কাছের মানুষ হয়, যার সঙ্গে সে নিজের সব মনের কথা খুলে বলে। তবে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই যাচাইবাছাই করে নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে একজন ভালো বন্ধু যেমন জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে ঠিক তেমনি একজন খারাপ বন্ধুও জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, “হে ইমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো এবং সর্বদা সত্যবাদীদের সঙ্গে থেকো।” (সূরা তওবা, আয়াত ১১৯)। এই আয়াতে এটাই বলা হয়েছে সত্যবাদীদের সাহচর্য লাভ ও তাদের আমলের মাধ্যমেই তাকওয়া লাভ করা সম্ভব হয়। আর এভাবেই কেউ বিপথগামী হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ কেয়ামতের দিন আরশের ছায়া দান করবেন, যেদিন ওই ছায়া ছাড়া আর অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। এর মধ্যে সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং এই বন্ধুত্বের ওপরেই তারা পরস্পর সাক্ষাৎ করে এবং তার ওপরই বিচ্ছিন্ন (ইহলোক ত্যাগ করে) হয়।” (বুখারি শরিফ ৬৬০)।
আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষ তার সমাজ জীবনে বন্ধু দ্বারাই প্রভাবিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিচালিতও হয়। তাই সৎ ও ধার্মিক বন্ধুর সাহচর্য গ্রহণ করা উচিত। কারণ, পৃথিবীতে খারাপ চরিত্রের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখলে পরকালে লজ্জা ও অনুশোচনার শেষ থাকবে না।

সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ দিতে গিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, “সৎ সংগী ও অসৎ সংগীর উদাহরণ হচ্ছে আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের ন্যায়। আতর বিক্রেতার সঙ্গে ওঠাবসা করলে আতর খরিদ করতে না পারলেও সে আতরের সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের হাপর হয়তো যে কোনো সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। পুড়িয়ে দিতে পারে তার আবাস না হয় দুর্গন্ধে তার চারপাশ ভারী করে দেবে।” (বুখারি শরিফ)।

বন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, “হে ইমানদারগণ, তোমরা কখনো ইহুদি খ্রিস্টানদের নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। কেননা এরা নিজেরা সব সময়ই একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এদের কাউকে বন্ধু বানিয়ে নেয় তাহলে সে অবশ্যই তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে।” (সুরা মায়েদা, আয়াত ৫১)।

আল্লাহ আরও বলেন, “ইমানদার ব্যক্তিরা কখনো ইমানদারদের বদলে কাফেরদের নিজেদের বন্ধু বানাবে না, যদি তোমাদের কেউ তা করে তবে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই থাকবে না।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ২৮)।

সুতরাং চাইলেই যে কাউকে বন্ধু বলা যায় না বা বন্ধু নির্বাচন করা ঠিক নয়। সত্যবাদী, নামাজি, দ্বীনদার, পরোপকারী, দানশীল ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করা উচিত।

কোরআনে এই আলোকে আল্লাহ দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, “হে নবী, তুমি নিজেকে সে সব মানুষের সঙ্গে রেখে চলবে, যারা সকাল সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তারা একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তুমি কখনো তাদের কাছ থেকে তোমার স্নেহের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না, এমন যেন না হয় যে, তুমি শুধু এ পার্থিব জগতের সৌন্দর্যই কামনা করো। কখনো এমন কোনো ব্যক্তির কথামতো চলো না যার হৃদয়কে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছে।” (সূরা কাহফ, আয়াত ২৮)।

আমাদের এই ছোট্ট জীবনে বন্ধুত্ব করতে হলে কোরআন ও হাদিসের আলোকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুম মেনে জীবন পরিচালিত করে তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব তৈরি করা উচিত। নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব শুধু আল্লাহর জন্যই হবে। দুনিয়ার কোনো স্বার্থের জন্য নয়। হজরত ইমাম জাফর আস সাদিক (রহ.) মুসলিমদের বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক করে বলেছেন, পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমীচীন নয়। তা হলো মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী ও কৃপণ ব্যক্তি।

আল্লাহ আরও বলেন, “মোমেন পুরুষ ও মোমেন নারীরা একে অপরের বন্ধু, এরা মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে। তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, সব কাজে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রসুলের অনুসরণ করে, এরাই হচ্ছে সে সব মানুষ যাদের ওপর আল্লাহতায়ালা অচিরেই দয়া করবেন, অবশ্যই আল্লাহতায়ালা পরাক্রমশালী ও কুশলী।” (সুরা তওবা, আয়াত ৭১)

আমাদের জীবন চলার পথে পথভ্রষ্ট হওয়ার একমাত্র কারণ হলো অসৎ ও খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা চলাফেরা করা। খারাপ বন্ধু আমার আপনার জীবনকে ভুল পথে পরিচালিত করে। জীবনে চলার পথে আপনি ভালো ও খারাপ বন্ধু সহজেই চিনতে পারবেন। যার সঙ্গে চলাফেরা করলে আপনার মধ্যে মানবীয় গুণ ও দীনের প্রতি অনুগত হওয়ার আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় তখনই বুঝতে পারবেন আপনার জীবনে একজন ভালো বন্ধুর আগমন ঘটেছে আর যদি খারাপ আচরণগুলো প্রভাবিত হতে থাকে তাহলে আপনি তাকে দ্রুত পরিত্যাগ করুন।

জীবন চলার পথে ভালো বন্ধুর সাহচর্য জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে বন্ধু নির্বাচন করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এই পৃথিবীতে যারা চরিত্রবান, সৎ, খোদাভীরু, দয়াবান, দানশীল, কথায় কথায় অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় না, গিবত করে না, আপনার দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দেয় তারাই আপনার জীবনে ভালো বন্ধু। তাদের সঙ্গেই আপনার বন্ধন হোক অটুট। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights