বাঁচামরার লড়াইয়ে ডাক

শামীম আহমেদ
একসময়ের ব্যস্ত ডাকঘরগুলো এখন পরিণত হয়েছে জনশূন্য ভবনে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডাকঘরগুলোতে কর্মী সংকট, অনিয়মিত সেবা এবং কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে। অনেক জায়গায় ডাকঘর তালাবদ্ধ থাকে, কিছু ডাকঘর ভিন্ন কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ডাকবিভাগের মাধ্যমে বর্তমানে সরকারি চিঠিপত্র ছাড়া সাধারণ জনগণের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক চিঠিপত্র বহন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দেশব্যাপী ডাকবিভাগের অফিস ও জনবল থাকলেও পার্সেল পাঠাতেও মানুষ এখন কুরিয়ার সার্ভিসের ওপর নির্ভর করছে। ঐতিহ্য হারিয়ে ডাকবিভাগ এখন মোবাইল ব্যাংকিং, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড, মেয়াদি সঞ্চয় স্কিম, জীবন বিমাসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবার মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার একটা শাখা ডাকঘরের নাম তলনা। স্থানীয় ডুমনি-পাতিরার বাসিন্দারা ঠিকানায় ডাকঘরের জায়গায় তলনা লিখলেও অনেকেই জানেন না সেটির অবস্থান। গত ২০ ফেব্রুয়ারি খুঁজতে খুঁজতে রুহুল আমিন খান উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায় ডাকঘরটির সাইনবোর্ড। তবে বাইরে নেই কোনো ডাকবাক্স। ডাকঘরটিও ছিল তালাবদ্ধ। পাশেই কাজ করছিলেন স্কুলের নৈশপ্রহরী জাহাঙ্গীর আলম। কথা বলে জানা যায়, তিনিই ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে পোস্ট অফিসটি দেখভাল করছেন। অফিসের তালা খুললে দেখা যায়, কক্ষটির এক কোনায় পড়ে আছে জরাজীর্ণ ডাকবাক্সটি। আসবাব হিসেবে থাকা দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার, একটি কাঠের টেবিল ও একটি বেঞ্চের ওপর জমেছে ধুলার পুরু আস্তর। অফিসে নেই কোনো খাম, রেজিস্টার বা রশিদ বই। জাহাঙ্গীর আলম জানান, মানুষ এখন আর চিঠিপত্র পাঠায় না। মাঝেমধ্যে কেউ পার্সেল বা রেজিস্ট্রি চিঠি পাঠাতে চাইলে ফোন করে। তখন তিনি সেটা সংগ্রহ করে খিলক্ষেত ডাকঘরে নিয়ে পোস্ট করে আসেন। তবে বিদেশ থেকে পার্সেল, জমির কাগজপত্র, তালাকনামা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, উকিল নোটিশ ও বিভিন্ন সরকারি চিঠি আসে। মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা ভাতা পান। চিঠি-পার্সেল বিতরণে খরচ হয় তার চেয়ে বেশি। যাদের পণ্য বিলি করেন, তারা খুশি হয়ে কিছু না দিলে ডাক সেবা চালু রাখা সম্ভব হতো না।

বাগেরহাটের মোংলায় শেহলাবুনিয়া শাখা ডাকঘরে গিয়ে দেখা যায়, ডাকবিভাগের কার্যক্রম তেমন না থাকলেও চলছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। পাশাপাশি সেখানে প্রাইভেট পড়ান শাখা পোস্টমাস্টার অনিরুদ্ধ হওলাদার। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও টিউশনির টাকা দিয়ে পরিবারের সঙ্গে বাঁচিয়ে রেখেছেন ডাকঘরের ঠিকানাটি।

অনিরুদ্ধ হাওলাদার জানান, ডাকঘরে কোনো পিওন নেই। তাই ডাক বিতরণের কাজ মূলত মোংলা মূল ডাকঘর থেকেই করা হয়। আশপাশের কিছু চিঠিপত্র তিনি নিজে বিতরণ করেন। মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা ভাতা পান। তিনি বলেন, এটাকে ই-সেন্টার ঘোষণা করে কয়েকটি ল্যাপটপ দিয়ে সরকারিভাবে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছিল। ল্যাপটপগুলো কয়েক মাসেই নষ্ট হয়ে গেছে। পরে নিজেরা টাকা দিয়ে ল্যাপটপ কিনে প্রশিক্ষণ চালিয়ে রেখেছেন। তবে ডাকবিভাগের বেশির ভাগ সেবাই সেখানে নেই বলে জানা গেছে।

বগুড়া থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রহমান টুলু জানান, বগুড়ার ২২০টি ডাকঘরের কোথাও অফিস আছে, কোথায়ও নেই। কার্যক্রমের জন্য নিজস্ব ভবন আছে ৪৩টির। ২৫টির কার্যক্রম চলছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর ৫০টি চলছে ইডি-পোস্টমাস্টারের বাস ভবনে। আর ৫৩টির কার্যক্রম চলছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন নিজস্ব কক্ষে, ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের কক্ষে ও ১৫টি অন্যান্য সরকারি অফিস ভবনে। বেশির ভাগ ডাকঘরে জনবলসংকট। বিভিন্ন স্থানে এখনো কিছু ডাকবাক্স দেখা গেলেও সেগুলো ভাঙা ও জরাজীর্ণ।

যেখানে গত কয়েক বছরে দেশে কুরিয়ার ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে, সেখানে দেশের আনাচে-কানাচে অফিস ও জনবল থাকার পরও ঐতিহ্যবাহী ডাকবিভাগের নাজুক অবস্থা। সাধারণ মানুষ বলছেন, ডাকে প্রেরিত চিঠি সময়মতো পৌঁছায় না, অনেক সময় ফেরত আসে। পার্সেল পাঠালে সময় বেশি লাগে। কুরিয়ারে পার্সেল পাঠাতে ফোন করলে বা অ্যাপে অর্ডার দিলে বাসা থেকে পণ্য নিয়ে যায়। অনলাইনে পার্সেল ট্রাকিং করা যায়। ডাকে পাঠাতে হলে পোস্ট অফিসে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায় না। এসব কারণেই ডাকসেবার প্রতি মানুষের নির্ভরতা কমে গেছে।

এ ব্যাপারে ডাক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (ডাক সেবা) এস এম শাহাবউদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডাকসেবা আধুনিকায়ন ও সেবার পরিধি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনবলসংকট কমাতে বর্তমানে ৩ হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ডাকঘরকে ই-সেন্টার করা হয়েছে। বর্তমানে ৯ হাজার ৯৭৪টি ডাকঘর আছে দেশে। তবে কোনো ডাকঘরের কার্যক্রম কমে গেলে সেটা সাময়িক স্থগিত রেখে স্থান পরিবর্তন করে আবার চালু করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights