বেতন-বোনাসের চাপে শিল্প আরো নাজুক
অনলাইন ডেস্ক
আর কদিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ সময়ে শিল্প-কারখানার সক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক কর্মীদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা সব শিল্প মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় সব শিল্প-কারখানা রুগ্ণ হয়ে পড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বকেয়া বেতন-ভাতা, বোনাসসহ নানা দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনে অস্থির হয়ে উঠেছিল শিল্পাঞ্চল।
অনেক কারখানায় উৎপাদন কমে যায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে বড় বড় সরকারি প্রকল্প স্থবির হয়ে সরকারি ব্যয়ও কমে গেছে। আর এতে নির্মাণসহ অনেক সংযোগ শিল্প খাত রুগ্ণ হওয়ার পথে। এ অবস্থায় কারখানায় উৎপাদনক্ষমতা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিল্প-কারখানার মালিকরা। ফলে ঈদ সামনে রেখে কর্মীদের মজুরি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।
তবে দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্প কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও কম দামে কার্যাদেশ নেওয়া, কারখানায় জ্বালানিসংকট এবং কাঁচামাল আমদানিতে ডলার সংকটে তারাও চাপে আছে। সরকারের দেওয়া প্রণোদনার বড় অঙ্ক এখনো আটকে রয়েছে।
এর মধ্যেই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, বোনাসসহ সব পাওনা আগামী ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া মালিকপক্ষ তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী শ্রমিকদের মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতন পরিশোধ করবে। আসন্ন ঈদুল ফিতরপূর্ব শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনা, শিল্প সেক্টরের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও ছুটিসংক্রান্ত পর্যালোচনার জন্য ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) ৮৫তম বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে সরকারের কাছে ১৫ রমজানের মধ্যে সাত হাজার কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে দেশের রপ্তানি খাত সামাল দিতে নিটওয়্যার কারখানা মালিকদের সংগঠনটি এই সহায়তা চেয়েছে। তাদের দাবি, অর্থ সহায়তা না পেলে ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধে চরম বিপাকে পড়তে পারে পোশাক খাত।
সম্প্রতি বিকেএমইএ অর্থ সহায়তাসংক্রান্ত একটি চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিবের কাছে পাঠায়। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের সই করা চিঠিতে বলা হয়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এক কঠিন সময় পার করছে। তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর ফলে কার্যাদেশ বাড়লেও বিভিন্ন কারখানায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সামনে বেতন ও ঈদ বোনাসের বিশাল চাপ রয়েছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য ভাতা পরিশোধ করতে না পারলে আবার শ্রম অসন্তোষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার সুযোগ পাবে। তাই নগদ সহায়তা বাবদ সাত হাজার কোটি টাকা ছাড় করা না হলে রপ্তানি খাতে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, বিগত সময়েও দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের কারখানায় শ্রম অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। ফলে কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তাই এই সময়ে অস্বাভাবিকভাবে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে।
রপ্তানি শিল্পের ওপর কিছু দেশের বায়ারদের আস্থা ধরে রাখতে তৈরি পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা অনেক ক্ষেত্রে মূল উৎপাদন খরচ থেকে কম মূল্যে কার্যাদেশ গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন। ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কার্যাদেশ বাড়লেও বিভিন্ন কারখানায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সামনেই আছে ঈদের বেতন ও বোনাসের বিশাল চাপ। এমন পরিস্থিতিতে বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য ভাতা পরিশোধ করতে না পারলে শ্রম অসন্তোষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ন্যূনতম পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড় পেলে শ্রমিক-মালিক উভয়ের জন্য স্বস্তির হবে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, কারখানা চালু রাখতে কর্মীও দরকার। কিন্তু শিল্প-কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসসংকটে শিল্প-কারখানাগুলো চালানো যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কারখানা চালু রাখতে কম দামে কার্যাদেশ নিতে হচ্ছে। যে পরিমাণ রপ্তানি হয়, সেই পরিমাণে টাকা আসছে না। তাই লাভের মার্জিনও থাকছে না। ফলে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের।’
তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে শ্রমিকদের মজুরি, বোনাস দিতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। কোনো শ্রমিক তাঁদের পাওনা না নিয়ে বাড়ি যাবেন না। এর জন্য সরকারকে আরেকটু সহনীয় হতে হবে। সরকারের কাছে এখনো প্রণোদনার সাত হাজার কোটি টাকা পাওনা। এর মধ্যে সম্প্রতি দুই হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে আরো অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়ার দাবি জানিয়েছি আমরা।’
সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘অন্য খাতগুলোর মতো দেশের পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারকরাও ভালো নেই। এই খাতের প্রায় দুই লাখ শ্রমিকের নিয়মিত মজুরি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক ক্রেতাদের আগ্রহের ঘাটতি, কার্যাদেশ কম এবং ব্যাংকিং সুবিধা ব্যাহত হওয়ায় আর্থিক লোকসানে পড়েছেন উদ্যোক্তারা।’
বস্ত্র খাতের একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এর পরও গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। গ্যাসসংকটে ডিজেল দিয়ে ডায়িং কারখানায় উৎপাদন করা গেলেও স্ট্যান্ডার্ড ও ড্রাক করা যাচ্ছে না। আর ফ্যাব্রিকস ডায়িং করাতে না পেরে সুইং, ফিনিশিং, নিটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সেকশনের শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে।
বস্ত্র খাতের বড় সংগঠন বিটিএমএ পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘ভারতের আগ্রাসন ও সুতা অ্যান্টিডাম্পিং করার ফলে চলতি বছর রোজার ঈদে স্থানীয় বাজারে প্রায় দেড় শ কোটি ডলারের পণ্য অবিক্রীত থাকবে। এ ছাড়া গত এক বছরে এই খাতের উদ্যোক্তাদের প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য কম বিক্রি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার তাদের উদ্যোক্তাদের সুতা উৎপাদনে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে ৩০ শতাংশ বেশি সুতা আমদানি করেছেন। এতে দেশীয় সুতা ডাম্পিং হচ্ছে।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ