যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার আতঙ্কে তটস্থ লক্ষাধিক প্রবাসী

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি :

যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস অতিরিক্ত বরাদ্দের বিল অনুমোদনের পর অবৈধ অভিবাসী গ্রেফতার ও বহিষ্কারের প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। এর ফলে নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউজার্সি, মিশিগান, ইলিনয়, আলাবামা, পেনসিলভেনিয়া, টেক্সাস, ম্যাসাচুসেট্‌স, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া ও ওয়াশিংটন মেট্র এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে লক্ষাধিক প্রবাসী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে বহুবছর আগেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ জারি হয়েছে। অর্থাৎ তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে আইনি লড়াই চালিয়েও স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাননি।

এরমধ্যে যোগ হয়েছে আরো কয়েক হাজার শিক্ষার্থী, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে সক্ষম হননি। তাদের ভিসাও আপনা-আপনি বাতিলের পর অনেকে চেষ্টা করেছেন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা অথবা ইউএস সিটিজেনকে বিয়ের মাধ্যমে ইমিগ্রেশনের স্ট্যাটাস ধরে রাখতে। তবে খুব কমসংখ্যকই এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন বলে ইমিগ্রেশন এটর্নীরা এ সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরেরও অধিক সময় আগে থেকে যারা অবৈধ অভিবাসীর তালিকাভুক্ত হয়েছেন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ এক ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করছেন। অনেকে রেস্টুরেন্ট, মুদির দোকান, নিউজ স্ট্যান্ড কিংবা নির্মাণ শ্রমিক অথবা ডেলিভারিম্যানের কাজ করে দিনাতিপাত করতেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পরদিন থেকেই তাদের অনেকে বাসা পাল্টিয়েছেন, কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন আইসের গ্রেফতার-অভিযান এড়াতে। নিউইয়র্ক, লসএঞ্জেলেস, ফিলাডেলফিয়া, বস্টনের মত স্যাঙ্কচুয়্যারি সিটিতেও আইসের অভিযান শুরুর পর এসব মানুষের শেষ ঠাঁইটিও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে।

এর আগে, স্যাঙ্কচুয়্যারি সিটির স্কুল-কলেজ-মসজিদ-মন্দির-চার্চ-হাসপাতালে আইসের অভিযানের এখতিয়ার ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অঘোষিত এক নীতি অবলম্বন করেছেন এসব সিটির বিরুদ্ধে। তারা যদি অবৈধ গ্রেফতার অভিযানে আইসকে সহায়তা না দেয় তাহলে ফেডারেলের সকল মঞ্জুরি বাতিল করা হবে। এমন হুমকিতে কোন সিটিই ঝুঁকি নিতে চায়নি।

অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, প্রকৃত অর্থে কতজন বাংলাদেশি অবৈধভাবে রয়েছেন তার সংখ্যা কখনোই জানা সম্ভব হয় না। কারণ, তাদের অনেকেই মেক্সিকো কিংবা কানাডা হয়ে বেআইনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছেন। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ইমিগ্রেশনে আবেদন করেছিলেন। এজন্য সংখ্যাগত সমস্যা রয়েই গেছে। এ ব্যাপারটি শুধু বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র জনগোষ্ঠির জন্যেই।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের আদালত থেকে বহিষ্কারের আদেশ জারি হওয়া অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটি ৪০ লাখের বেশি। সেটিকে ধরে নিয়েই চালানো হচ্ছে গ্রেফতার অভিযান। যদিও নির্বাচনী অঙ্গিকারের সময় ট্রাম্প বলেছেন যে, কেবলমাত্র তাদেরকেই গ্রেফতার ও বহিষ্কার করা হবে যারা গুরুতর অপরাধী হিসেবে দণ্ডিত হয়েছে অথবা ফেরার জীবন-যাপন করছে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। অভিযানের সময় যারাই সামনে পড়ছে তারাই গ্রেফতার হচ্ছেন। এমনকি সাথে আইডি না থাকায় অনেক গ্রীনকার্ডধারীকেও ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছিল।

এমন সাঁড়াশি অভিযানে দিশেহারা অনেকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যও ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যের সোস্যাল সিকিউরিটি নম্বরে যারা ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করতেন তারাও এখোন আর কর্মস্থলে যাচ্ছেন না। গতমাস থেকেই এসব ফাস্টফুড এবং কম্যুনিটিভিত্তিক রেস্টুরেন্ট-গ্রোসারিতে কর্মচারির সংখ্যা কমেছে। এমনকি দিনভর আড্ডা দেয়া অতিপরিচিত লোকজনের আনাগোনাও নেই বললেই চলে।

৫ মার্চ নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, নেপালি ও ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্রেতার সংকট দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে বিপুল পণ্য সামগ্রী আমদানি করে তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। নিত্য পরিচিত ফুচকা, ঝাল-মুড়ির দোকানেও ভীড় দেখা যায়নি ইফতারের পর। রেস্টুরেন্টেও রোজাদারের ভীড় নেই বললেই চলে।

আগে দেখা যেত- স্টুডেন্ট ভিসায় আগতরা এবং অন্য প্রোগ্রামে অবৈধ হয়ে পড়া ব্যাচেলর প্রবাসীরা সচরাচর রেস্টুরেন্টে ইফতার করতেন। আইসের আতঙ্কে তারা আসছেন না। স্টুডেন্ট ভিসাধারী অনেককে গ্রেফতারের সংবাদে অন্যরা ফুচকার রুচি হারিয়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ গোটা কম্যুনিটিকে গ্রাস করেছে একধরনের গ্রেফতার আতঙ্ক। অনেকে পাল্টেছেন সেলফোনের সীম। কারণ আইস সেলফোনের মাধ্যমে টার্গেটেড অবৈধদের হদিস উদঘাটন করে বলে শোনা যাচ্ছে।

এদিকে, ২১ জানুয়ারিতে শুরু অভিযানে সারা আমেরিকায় কতজন বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি ৬ মার্চ পর্যন্ত। তবে কম্যুনিটি ও ইমিগ্রেশন এটর্নি অফিস সূত্রে সেই সংখ্যাটা কোনভাবেই অর্ধ শতের বেশি হবে না বলে জানা গেছে। একইসময়ে কয়েকশত প্রবাসী গ্রেফতারের আতঙ্কে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে ফিরে গেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।

গ্রেফতার অভিযান সন্তোষজনক নয় বলে গত মাসে কংগ্রেসে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিল পাশ করা হয়েছে। এর সিংহভাগ ব্যয় করা হবে অভিবাসন গ্রেফতারের অভিযান জোরদারের জন্যে। যদিও এই অর্থকেও পর্যাপ্ত মনে করা হচ্ছে না প্রয়োজনের তুলনায়। কারণ, গ্রেফতারের পর নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। বিমানের ভাড়াও পরিশোধ করতে হয় ফেডারেল সরকারকেই। এজন্য বিপুল অর্থ প্রয়োজন-যার সংকট দীর্ঘদিন থেকেই রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights