রোমহর্ষক আয়নাঘর প্রকাশ্যে
বিশেষ প্রতিনিধি
শেখ হাসিনার আমলে এ রকম গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো মানুষ। দেয়ালে বন্দিরা লিখেছেন নানা কথা। পাওয়া গেছে নির্যাতন করার চেয়ার ছবি : প্রধান উপদেষ্টার অফিস
অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি দেয়াল। চকে আঁকা ছবি মুছে ফেলা হয়েছে। তার পাশে লেখা, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা… মিনাজ জোয়ালিমিন’।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের গোপন বন্দিশালা, যা আয়নাঘর নামে পরিচিত, তার এমন খণ্ড খণ্ড চিত্র উঠে এসেছে ছবিতে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে বলে ওঠেন, ‘কী বীভৎস দৃশ্য! প্রতিটি জিনিস যা হয়েছে, এখানে তা ছিল নৃশংস! যতই শুনি, অবিশ্বাস্য মনে হয়! এটা কি আমাদেরই জগৎ! আমাদের সমাজ! আমরা এটা করলাম!’
গতকাল সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, গুম কমিশনের সদস্য, ভুক্তভোগী এবং একটি দেশি ও দুটি বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী নিয়ে রাজধানীর তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। শুধু রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভি এবং বিদেশি গণমাধ্যমের মধ্যে আলজাজিরা ও নেত্র নিউজের প্রতিনিধি সঙ্গে ছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত এবং উত্তরার আয়নাঘর পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা। এর মধ্যে দুটি র্যাবের এবং একটি ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর।
পরিদর্শনের সময় আয়নাঘরের দেয়াল দেখে চিনতে পারেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)-এর টর্চারসেলে (আয়নাঘর) আটকে রাখা হয়েছিল জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে। তাঁরা জানান, জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাঁদের তুলে নেওয়া হয়। আয়নাঘর পরিদর্শনের পর আসিফ জানান, তাঁকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল সেই কক্ষের দেয়ালের ওপরের অংশের খোপগুলোতে এগজস্ট ফ্যান ছিল, এখন নেই।
আসিফ আরও জানান, তিনি দেয়াল দেখে কক্ষটি চিনতে পেরেছেন। কক্ষটি আগে অনেক ছোট ছিল, এখন মাঝের দেয়াল ভেঙে বড় করা হয়েছে। ওই কক্ষে তাঁকে চার দিন আটকে রাখা হয়েছিল। এ সময় বাইরের কারও সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। টয়লেট ছিল কক্ষের বাইরে এবং তাঁকে চোখ বেঁধে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হতো। আয়নাঘর পরিদর্শনের পর নাহিদ জানান, তাঁকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল সে কক্ষের একপাশে টয়লেট হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল। ৫ আগস্টের পর এ সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়।
..
প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের আয়নাঘর পরিদর্শনের পর বেলা আড়াইটায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ প্রসঙ্গে ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এবং অপূর্ব জাহাঙ্গীর। উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ ও সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি। তার আগে আয়নাঘর নিয়ে (বিটিভি) ধারণকৃত ভিডিও ও প্রেস উইং এবং পিআইডির ছবি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
ব্রিফিংয়ে শফিকুল আলম বলেন, সারা দেশে এমন ৭০০ থেকে ৮০০ আয়নাঘর রয়েছে। সেখানে ভুক্তভোগীদের কীভাবে রাখা হতো, কীভাবে তাদের নির্যাতন করো হতো, কীভাবে তারা দিনগুলো কাটিয়েছেন এ পরিদর্শনে এর একটা বিবিধ চিত্র দেখা গেছে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। বাংলাদেশে যত আয়নাঘর আছে প্রতিটি খুঁজে বের করা হবে বলেও জানান প্রেস সচিব। হিউম্যান রাইটসওয়াচের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, নিউইয়র্কভিত্তিক এ মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে, এ গুম-খুনের সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা জড়িত। তাঁর অর্ডারে বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে।
আয়নাঘরের কোনো আলামত নষ্ট হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, কিছু কিছু জায়গায় প্লাস্টার করা হয়েছে; কোনো কোনো জায়গায় কক্ষটি একটু ছোট ছিল যেটা ভেঙে বড় দেখানো হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত নাকি তা গুম কমিশন দেখছে বলেও জানান তিনি। পূর্ণ তদন্তের জন্য প্রতিটি আয়নাঘর সিলগালা করে রাখা হবে বলেও জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, আওয়ামী লীগের যারা গুম, খুন হত্যাকাে র সঙ্গে জড়িত, যাদের হাতে রক্ত তাদের সবার বিচার হবে।
আওয়ামী লীগের দায় প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, আওয়ামী লীগ পার্টির কী হবে, সেটা দেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। জনগণ দেখছে ১৫ বছর তারা কী করেছে। তারা উন্নয়নের গল্প শুনিয়েছে, কিন্তু আমরা গিয়ে দেখলাম শুধু অন্ধকার …!
এক সাংবাদিক জানতে চান, আপনারা যেটাকে আয়নাঘর বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে এমন শোনা যাবে কি না এ সরকারের আমলেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এ ধরনের আয়নাঘরে রাখা হয়েছে? জবাবে প্রেস সচিব বলেন, গত ছয় মাসে আপনারা দেখছেন… আমাদের যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে রিপোর্ট করেন। আমরা স্বাগত জানাই।
প্রেস সচিব বলেন, আমাদের সময়ে কিছু কিছু জায়গায় যে বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা বলা হচ্ছে, প্রতিটি ঘটনা তদন্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটায় এ সরকার সেটি নিশ্চিত করবে বলেও জানান তিনি।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টের তথ্য তুলে ধরেন উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। তিনি জানান, গুম-খুন নিয়ে জাতিসংঘের সুপারিশগুলো সরকার বিবেচনা করবে এবং এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৫ বছরে যা করেছে, তার ক্ষুদ্র একটি অংশ প্রকাশ পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘের রিপোর্টে। কসাই শেখ হাসিনার যে লিগ্যাসি তার যোগফলই হচ্ছে এ দুটো রিপোর্ট।