শবে মেরাজে যা কিছু দেখেছেন মহানবী (সা.)
মুফতি এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ
মেরাজ শব্দের অর্থ হলো ঊর্ধ্বগমন। শবেমেরাজ মানে ঊর্ধ্বগমনের রাত। শব শব্দটি ফারসি, যার অর্থ রাত। আরবিতে বলা হয় লাইলাতুল মেরাজ।
মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন আদম (আ.)-কে ঘিরে আছে অনেক লোক। তিনি ডানে তাকালে হাসছেন আর বাঁ তাকালে কাঁদছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বলা হলো—এরা সবাই আদমের বংশধর। আদম (আ.) তাঁর নেক বংশধরদের দেখলে হাসতেন আর অসৎ বংশধরদের দেখলে কাঁদতেন। এরপর নবী (সা.)-কে বিস্তারিত দেখার জন্য সুযোগ করে দেওয়া হয়।
১. এক স্থানে তিনি দেখলেন কিছু লোক ফসল কাটছে, যত কাটছে ততই বাড়ছে। মহানবী (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে প্রশ্ন করলেন—ভাই, এরা কারা? এ প্রশ্নের জবাবে জিবরাইল (আ.) বলেন, এরা আল্লাহর পথে জিহাদকারী।
২. এরপর দেখলেন কিছু লোকের মাথা পাথর মেরে চূর্ণ করা হচ্ছে।
এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল এরা ওই সব লোক, যাদের অনীহা ও অসন্তোষ তাদের নামাজের জন্য উঠতে দিত না।
৩. এরপর তিনি এমন কিছু লোক দেখতে পেলেন, যাদের কাপড়ের আগে-পিছে তালি দেওয়া। আর তারা পশুর মতো ঘাস খাচ্ছে। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হলো, এরা তাদের সম্পদের জাকাত আদায় করত না, দান-খয়রাতও করত না।
৪. এরপর তিনি এমন একজন লোক দেখলেন, যে ব্যক্তি কাঠ জমা করে বোঝা হিসেবে ওঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও আরো বেশি কাঠ তার বোঝার সঙ্গে যোগ করছে।
এই লোকটির পরিচয় জানতে চেয়ে উত্তর পেলেন, এ ব্যক্তির ওপর এত বেশি দায়িত্বের বোঝা ছিল যে সে বহন করতে পারত না। তা সত্ত্বেও বোঝা কমানোর পরিবর্তে আরো অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিত।
৫. এর পরের দৃশ্যে তিনি দেখলেন, কিছু লোকের ঠোঁট ও জিহ্বা কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলা হলো, এরা ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তা। মুখে যা আসত তাই বলত। এই সমাজে ফিতনা সৃষ্টি করত।
৬. তারপর এক স্থানে একটি পাথর দেখা গেল, যার মধ্যে ছিল সামান্য ফাটল। তার মধ্য থেকে একটা মোটাসোটা বলদ বেরিয়ে এলো। পরে এর মধ্যে ঢুকতে চেয়ে পারল না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বলা হলো, এটা হলো এমন দায়িত্বহীন ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে ফিতনা সৃষ্টি করার মতো উক্তি করে লজ্জিত হয়ে প্রতিকার করতে চায়, কিন্তু পারে না।
৭. এক স্থানে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখলেন, কিছু লোক তাদের নিজেদের গোশত কেটে কেটে খাচ্ছে। তাদের পরিচয় বলা হলো, এরা অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ ও কটূক্তি করত।
৮. তাদের পাশেই এমন কিছু লোক ছিল, যাদের হাতে নখ ছিল তামার তৈরি, তা দিয়ে তারা তাদের মুখ ও বুক আঁচড়াচ্ছিল। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হলো, এরা মানুষের অসাক্ষাতে তাদের নিন্দা চর্চা করত। তাদের সম্মানে আঘাত করত।
৯. কিছু লোকের ঠোঁট দেখা গেল উঠের ঠোঁটের মতো এবং তারা আগুন খাচ্ছে। তাদের সম্পর্কে বলা হলো, এরা এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করত।
১০. এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন কিছু লোক দেখতে পেলেন, যাদের পেট ছিল অসম্ভব বড় এবং বিষাক্ত সাপে পরিপূর্ণ। লোকজন তাদের দলিত-মথিত করে তাদের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে; কিন্তু তারা কিছু করতে পারছে না। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হলো এরা ছিল সুদখোর।
১১. এরপর আল্লাহর নবী এমন কিছু লোক দেখলেন, যাদের একদিকে রাখা ছিল ভালো গোশত। অন্যদিকে রাখা ছিল পচা দুর্গন্ধযুক্ত গোশত। তারা ভালো গোশত রেখে পচা গোশত খাচ্ছিল। তাদের পরিচয়ে বলা হলো, এরা ছিল এমন লোক, যারা নিজেদের হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে যৌন বাসনা চরিতার্থ করত।
১২. সেই সঙ্গে এমন কিছু স্ত্রীলোক দেখলেন যারা তাদের স্তনের সাহায্যে লটকে ছিল। তাদের সম্পর্কে বলা হলো যে এরা ছিল এমন স্ত্রীলোক, যারা তাদের স্বামীর ঔরসজাত নয়—এমন সন্তানকেও স্বামীর ঔরসজাত হিসেবে দাবি করত।
এসব দৃশ্য পর্যবেক্ষণকালে নবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ হয় এমন এক ফেরেশতার সঙ্গে যাকে রুক্ষ ও কাটখোট্টা মেজাজের মনে হচ্ছিল। নবী (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন এতক্ষণ যত ফেরেশতার সঙ্গে দেখা হলো সবাইকে তো খোশমেজাজে দেখলাম। ইনি এমন কেন? জিবরাইল (আ.) বলেন এর হাসিখুশির কোনো কারবার নেই। এ যে জাহান্নামের দারোগা। এ কথা শুনে আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহান্নাম দেখতে চাইলেন, তাত্ক্ষণিকভাবে তার দৃষ্টির পথ থেকে পর্দা উঠিয়ে দেওয়া হলো এবং জাহান্নাম তার ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হলো।
সপ্ত আসমান অতিক্রম করে আরশে আজিম সফর
প্রথম আসমানে আদম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আদম (আ.) নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সাদর অভ্যর্থনা জানান। এ সময় গোটা নভোমণ্ডল থেকে ধ্বনি ওঠে মারহাবা, মারহাবা। এ স্তর পার হয়ে তিনি দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছলেন। এখানে পরিচয় হলো ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর সঙ্গে। তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সপ্তম আসমানে পৌঁছে একটি আজিমুশান মহল বায়তুল মামুর দেখলেন। এখানে অসংখ্য ফেরেশতা আসছিলেন-যাচ্ছিলেন। এখানে তাঁর এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, যাঁর সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য ছিল। পরিচয় জানতে পারলেন ইনি হলেন ইবরাহিম (আ.)। এরপর আরো ওপরে উঠতে শুরু করলেন। উঠতে উঠতে তিনি সিদরাতুল মুনতাহা পৌঁছে গেলেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সিদরাতুল মুনতাহার কাছে, যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ১৪ ও ১৫)
পরে তাঁর জন্য রফরফ চলে এলো, সেখানে আরোহণ করে আরশে আজিমে রওয়ানা হলেন একাকী। তিনি ওপরে উঠতে উঠতে এত ওপরে উঠলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অর্থাৎ তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে। অতঃপর সে তাঁর নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম।’
(সুরা : নাজম, আয়াত : ৭, ৮, ৯)
সেখানে তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে আরো অনেক কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। যেসব কথাবার্তা হয়েছিল আল্লাহ তাআলার সঙ্গে তার দু-একটি তুলে ধরা হলো—
১. বান্দার শিরক ছাড়া অন্য যেকোনো গুনাহ মাফ করে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করা হয়েছে।
২. সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
৩. যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তার জন্য একটি নেকি লেখা হয়। আর যখন সে বাস্তবে আমল করে তখন ১০টি নেকি লেখা হয়; কিন্তু যে ব্যক্তি পাপ কাজ করার ইচ্ছা করে তার বিরুদ্ধে কিছু লেখা হয় না। আর যখন সে তা বাস্তবে করে তখন তার জন্য একটি মাত্র পাপ লেখা হয়।
৪. প্রতিদিন ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়, যা পরে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয় এবং ঘোষণা দেওয়া হয়—‘মা ইউবাদ্দালুল কাওলু লাদায়্যা ওয়ামা আনা বিজল্লামিন লিল আবিদি’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আমার মহান সত্তার পক্ষ থেকে কোনো কথা পরিবর্তন করা হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের ওপর বেশি কষ্ট দিতে চাই না। তাই আপনি এবং আপনার উম্মতকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পাঁচ-এর পরিবর্তে ৫০ ওয়াক্তই লেখা হবে। যেমন—মহান আল্লাহ সুরা আনআমে এ ইরশাদ করেছেন, ‘মান জাআ বিলহাসানাতি ফালাহু আশারা আমছালিহা।’
অর্থাৎ : হে নবী! যে আমার নৈকট্যের জন্য একটি নেকের কাজ করবে তার জন্য এক নেকির পরিবর্তে ১০টি নেকি লেখা হবে। (সুবহানাল্লাহ)
আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে আসেন সিদরাতুল মুনতাহায়। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে জিবরাইল (আ.)সহ বোরাকযোগে বাইতুল মুকাদ্দাসে এলেন। তারপর আবার বোরাকে আরোহণ করে মক্কায় চলে এলেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মেরাজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।