সম্পদলোভী সালাবার অভিশপ্ত জীবন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
নবীজি (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন শূন্য হাতে। সঙ্গে যারা ছিলেন তারাও সবাই আর্থিকভাবে নিঃস্ব। নবীজি (সা.) ও তাঁর হিজরতের সঙ্গীদের অর্থ-সম্পদ-জমিজমা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মদিনার সৌভাগ্যবানরা। যারা হিজরত করেছেন তাদের বলা হয়- মুহাজির বা শরণার্থী। তাদের যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের বলা হয়- আনসার বা সাহায্যকারী। মুহাজির ও আনসারদের মর্যাদা সম্পর্কে কোরআনে আলাদা করে উল্লেখ আছে। সালাবা ছিলেন আনসার সাহাবি। পুরো নাম সালাবা বিন হাতিব আল আনসারি। ইমানের পথে তার যাত্রা শুরু সৌভাগ্যবান হিসেবেই। তবে নিজের লোভের কারণে নবীজির অভিশাপ কুড়িয়ে চির হতভাগ্যদের খাতায় নাম লেখায় বেচারা। ইবনে জারির তাবারি, ইবনে কাসির, মারেফুল কোরআন ও কানজুল ইমানসহ জগৎবিখ্যাত তাফসিরের কিতাব থেকে তুলে ধরছি সেই ঘটনা। ঝকঝকে রোদেলা দুপুর। খেজুর গাছের ছায়ায় ঘেরা মসজিদে নববীতে সাহাবিদের নিয়ে বসে আছেন রসুল (সা.)। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল- ‘হে নবী! দোয়া করেন আল্লাহ যেন আমাকে সম্পদে ভরপুর করে দেন।’ নবীজি (সা.) ভালো করে তাকিয়ে দেখেন সালাবার লোভে চকচক জিহ্বা কথা বলছে। তিনি জানতেন লোভের পরিণতি সালাবাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। রসুল (সা.) মিষ্টি করে বললেন, ‘অঢেল সম্পদ পেয়ে না-শোকর বান্দা হওয়ার চেয়ে অল্প পেয়ে শোকর গোজার বান্দা হওয়া অনেক ভালো।’ হতভাগা সালাবা বুঝতে পারেনি নবুওয়াতি সতর্ক বার্তা। সে আবার বলল, ‘আমার জন্য দোয়া করেন আমি যেন অঢেল সম্পদের মালিক হই।’ রহমতের নবী আরও স্পষ্ট করে বোঝালেন-‘তুমি কি পার না নবীর মতো হতে হে সালাবা! আমি বললে মদিনার পাহাড়গুলো সোনায় পরিণত হয়ে আমার পেছনে চলবে। কিন্তু সম্পদ-বিলাসিতার পরিবর্তে অভাব-দরিদ্রতাই বেছে নিয়েছি আমি।’

বোধ হয় কিছুটা বুঝতে পেরেছে সালাবা। কী সতর্ক তাঁকে করা হচ্ছে। সম্পদ-বিলাসিতা মানুষকে ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আত্মীয়তার অধিকার রক্ষা থেকে বারণ করে। শোকর গোজার বান্দা হতে বাধা দেয়। কোনো কথা না বলে উঠে চলে গেল সালাবা। তবে অল্প পরে আবার ফিরে আসে একই আরজি নিয়ে- ‘হে নবী! আমি ওয়াদা করছি সম্পদ আমাকে দীন থেকে দূরে রাখতে পারবে না। আমি আল্লাহ ও বান্দার হক পুরোপুরিভাবে আদায় করব। আমার জন্য দোয়া করেন আমি যেন প্রচুর সম্পদের মালিক হই।’ নাছোড় সালাবা। অঙ্গীকার ভালো নিয়তের। অগত্যা দোয়ার হাত বাড়ালেন নবীজি- ‘হে আল্লাহ! সালাবাকে তুমি অঢেল সম্পদ দান কর।’ দোয়া কবুল হয়ে গেল। হাতেগোনা কয়েকটি ছাগলের মালিক সালাবা অল্প দিনের ব্যবধানে প্রচুর ছাগলের মালিক বনে গেল। তার ছাগলগুলো এত দ্রুত এবং এত বেশি বাচ্চা দিতে লাগল যে, নগরীর ছোট্ট খামারে জায়গা সংকুলান হলো না। সে চলে গেল মদিনা থেকে বেশ দূরে এক খোলা ময়দানে। দূরত্বের কারণে জোহর ও আসর ছাড়া আর কোনো নামাজ নবীজির সঙ্গে জামাতে আদায় করা সম্ভব হয় না। এর কিছুদিন পর ব্যস্ততার অজুহাতে কেবল জুমার নামাজ মসজিদে নববীতে এসে পড়ত সালাবা। আরও কিছুদিন পরের কথা। ততদিনে সে হয়ে উঠেছে মদিনার নামকরা ধনকুবের। খামারের পরিধি বাড়িয়ে আরও দূরে চলে গেল। দূরে চলে গেল মসজিদ থেকে, নবী থেকে, দীন থেকে। হায়! এখন তার নবীর পেছনে জুমা পড়ারও সময় হয় না। একদিন নবীজি (সা.) বললেন, ‘অনেক দিন হলো সালাবাকে দেখি না। তার কী হয়েছে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘সে এখন ভীষণ ব্যস্ত ব্যবসায়ী। তার প্রচুর ছাগল। অনেক বড় খামার। অনেক দূরে তার বাসা। মসজিদে আসার সময়-সুযোগ কোনোটাই হয় না তার।’ এসব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবীজি বললেন, ‘আফসোস! সালাবা শেষ হয়ে গেল! সালাবা শেষ হয়ে গেল! সালাবা শেষ হয়ে গেল!’

ঠিক এমন সময় জাকাত ফরজ হলো। সালাবার কাছে নোটিস দিয়ে দুজন লোক পাঠালেন নবীজি। সব শুনে সালাবা বলল, ‘এটা তো জাকাত না, কর আদায়ের নোটিস দেওয়া হয়েছে আমাকে। তোমরা পরে এসো আমি ভেবে দেখি।’ শেষ পর্যন্ত সে আর জাকাত দিলই না। আল্লাহর সঙ্গে করা ওয়াদা সে ভুলে গেছে। নবীজি বিষয়টি জানতে পেরে বললেন, ‘আহা! সালাবা ধ্বংস হয়ে গেছে! সালাবা ধ্বংস হয়ে গেছে! সালাবা ধ্বংস হয়ে গেছে!’ ওই মজলিসে সালাবার এক নিকটাত্মীয়ও ছিল। সে সালাবাকে বিষয়টি জানাল। এবার হুঁশ ফিরল তার। দৌড়ে এসে নবীর কদমে লুটিয়ে পড়ল। বলল, ‘ওগো নবী! আপনি আমার সম্পদ থেকে যে পরিমাণ ইচ্ছা জাকাত নিয়ে নিন।’ নবীজি বললেন, ‘এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার জাকাত নিতে আল্লাহ আমাকে বারণ করেছেন। এমনটি শুনে সালাবা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে আফসোস করতে লাগল। নবীজি বললেন, ‘তোমার এই হা-হুতাশও এক ধরনের প্রতারণা। আমি তোমাকে আগেই সতর্ক করেছিলাম। এখন আর তোমার কোনো সদকা নেওয়া যাবে না।’ কিছুদিন পর নবীজি (সা.)-এর ওফাত হয়। হতভাগা সালাবা খলিফা আবু বকরের দরবারে সম্পদের জাকাত নিয়ে হাজির হলে আবু বকরও (রা.) তা রাখেননি। ওমর (রা.)-এর সময়ও তার জাকাত নেওয়া হয়নি। উসমানও (রা.) তার জাকাত ফিরিয়ে দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights