স্বপ্ন ছুঁয়ে আপ্লুত দরিদ্র পরিবারের নারীরা

অনলাইন ডেস্ক
‘বান, বন্যা আর নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছি। স্বামী নাজমুল হোসেন অবস্থাপন্ন মানুষের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। চাষের খরচ, মালিককে ফসলের ভাগ দেওয়ার পর বড়জোর তিন-চার মাসের খোরাকি জোটে। তারপর স্বামী-স্ত্রী গায়ে-গতরে খেটে চার ছেলে-মেয়েসহ ছয়জনের সংসার টানতে হয়।

বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর উপহার হিসেবে পাওয়া এই সেলাই মেশিনটি বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিল।’ বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া সেলাই মেশিন পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাটিকামারীর চরের শাহনাজ বেগম এমন কথাই জানালেন। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনকবলিত গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানির দুস্থ ও অসহায় পরিবারের ২০ নারী পেয়েছেন সেলাই মেশিন। প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন পেয়ে সীমাহীন দারিদ্র্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা নারীদের বিষণ্নমুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক।

দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন যেন হাতে পেয়েছেন তাঁরা। সেই স্বপ্ন ছুঁতে পেরে আপ্লুত হন অনেকেই।

সম্প্রতি গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে বসুন্ধরা শুভসংঘ আয়োজিত সেলাই মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী গাইবান্ধা জেলার আমির মো. আব্দুল করিম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টিটুল, জেলা যুবদলের সভাপতি রাগীব হাসান চৌধুরী, ইসলামী ছাত্রশিবিরের জেলা সভাপতি ফেরদৌস সরকার রুম্মান, গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিসুজ্জামান মোনা ও যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ রোকনুজ্জামান। এ সময় বসুন্ধরা শুভসংঘ জেলা কমিটির সভাপতি হুমায়ুন আহমদ বিপ্লব ও সাধারণ সম্পাদক শাহনাজ বেগমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সূচনা বক্তব্যে বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান জানান, গত তিন বছর থেকে দেশের বিভিন্ন দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার অসচ্ছল নারীদের খুঁজে বের করে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের হাতে উপহার হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে তুলে দেওয়া হয় সেলাই মেশিন। সেই ধারাবাহিকতায় প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে কামারজানির নারীরা পেলেন একটি করে সেলাই মেশিন। এখন জীবনযুদ্ধে পরিবারকে সাহায্য করবেন তাঁরা। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতি মাসে অন্তত তিনটি করে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করা নারীরা পাচ্ছেন সেলাই মেশিন।’

স্বপ্ন ছুঁয়ে আপ্লুত দরিদ্র পরিবারের নারীরা

বসুন্ধরা গ্রুপ ও শুভসংঘের প্রশংসা করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘গাইবান্ধা দেশের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার একটি। এখানে নদ-নদীর ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে নারী ও শিশুরা বিপর্যস্ত। একজন নারী স্বাবলম্বী হলে সেই পরিবারের সন্তানরা সুশিক্ষার আলোতে উদ্ভাসিত হতে পারে। দরিদ্র পরিবারগুলোতে অশান্তি ও দুর্ভোগ দূর হয়। তারা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে। বসুন্ধরার দেওয়া এই সেলাই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন বিতরণ দুস্থ নারীদের স্বাবলম্বিতার পথে একটি আলোকবর্তিকা হতে পারে।’

জামায়াতে ইসলামী গাইবান্ধা জেলার আমির মো, আব্দুল করিম এই কার্যক্রমকে ‘মহতী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘অসহায় নারীর পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা সবার থাকে না। বসুন্ধরা শুভসংঘের কার্যক্রম নতুন ও আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার পথে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।’ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টিটুল জানান, বসুন্ধরা গ্রুপের এই কার্যক্রম গাইবান্ধার মতো পিছিয়ে পড়া জেলাকে উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করবে। যেকোনো ভালো ও মহৎ কাজে যুক্ত থাকতে পারা আনন্দের বিষয়। এই কর্মকাণ্ড সমাজের বিত্তবানদের নিশ্চয়ই মানুষের কল্যাণে কাজ করার প্রেরণা জোগাবে। জেলা জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি রাগীব হাসান চৌধুরী নারীদের স্বাবলম্বিতা অর্জনে সহায়তাদানের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা চাই সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে এমন ভূমিকা পালন করুক।’ জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ফেরদৌস সরকার রুম্মান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার বিপ্লবে যে নতুন বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছে, তার অগ্রযাত্রায় এ ধরনের পদক্ষেপকে ছাত্রসমাজ অবশ্যই সাধুবাদ জানায়। তবে দারিদ্র্যপ্রবণ এই এলাকায় সহায়তার প্রয়োজন আরো বেশি। আমরা বসুন্ধরা শুভসংঘকে তাদের কর্মকাণ্ড আরো বিস্তৃত করার আহবান জানাই।’ সেলাই মেশিন উপহার পেয়ে কামারজানির গোঘাট মাঝি পাড়ার গৃহবধূ সরস্বতী দাস আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাঁর চোখে অশ্রুবিন্দু থাকলেও কণ্ঠে ছিল উচ্ছ্বাস। বললেন, স্বামী হৃদয় চন্দ্র দাস পেশায় মৎস্যজীবী। এই সময়ে নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় আয় অনেক কম। তাঁদের এক মেয়েসহ তিনজনের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এখন তিনি সব ধরনের পোশাক তৈরি করতে পারেন। সেলাই মেশিনটি তাঁর অনেক সাধনার প্রাপ্তি। এখন বাড়ির কাজের পাশাপাশি পোশাক তৈরি করেও আয় করতে পারবেন। এতে তাঁর স্বামীর ওপর চাপ কমবে। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার স্বপ্ন পূরণ হবে। নদের তাণ্ডবে ঘরবাড়ি হারানো জেলেপাড়ার তাপসী সরকার, বাঁধের পাশে বসবাসকারী রোজিনা বেগম অনু, নীলা আক্তাররাও সেলাই মেশিন পেয়ে খুশি। রোজিনা বেগম বললেন, ‘অভাবের এই দুঃসহ জীবন থেকে বের হতে চাই। এই সেলাই মেশিনকে অবলম্বন করে এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights