কয়লায় চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কা
জিন্নাতুন নূর
দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম জ্বালানি হচ্ছে কয়লা। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। অথচ কয়লা সংকট এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২ হাজার মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ। এর ফলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার বড় একটা অংশই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল, ডলারের সংকট ও দরপত্র জটিলতায় কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারছে না বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এ অবস্থায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বছরের এ সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কম থাকায় অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রুটিন রক্ষণাবেক্ষণে যায়। আর যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা সংকট আছে তার সমাধান চলতি মাসে হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানা গেছে, দেশের সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধ আছে দুটি। আর বাকিগুলোর উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় বলে বেশ কয়েকটি বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে। এই কেন্দ্রগুলোর অনেকগুলো সময়মতো উৎপাদনে আসেনি। আবার কিছু উৎপাদনে আসার পর নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারেনি। বকেয়া বিল জমে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাপে পড়েছে।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা সংকটে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটি (৬৬০ মেগাওয়াট) রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামী দুই মাস বন্ধ থাকবে এ ইউনিট। বাগেরহাটে রামপালের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিরও একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে বরিশালের ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও। চট্টগ্রামে বাঁশখালীর বেসরকারি এসএস পাওয়ারের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি ইউনিটও বন্ধ রয়েছে বর্তমানে। অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানি করা আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ থাকায় তাপমাত্রা কমে এসেছে। এতে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে এসেছে। রাতে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটের মতো। কয়লায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখন বাড়তি খরচে জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাড়তি উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। দেশীয় কয়লায় চালিত একমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিট মিলে সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিজস্ব খনির কয়লা দিয়ে চালানো হয়। কয়লার অভাবে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। বর্তমানে একটি ইউনিট বন্ধ। আর অন্য দুটি ইউনিট থেকে উৎপাদন হচ্ছে ২২০ থেকে ২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দিনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পাঁচ হাজার টন কয়লা দরকার। যদিও চাহিদার অর্ধেক সরবরাহ করতে পারে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। এর বাইরে দেশের বাকি ৬টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালিত হয় আমদানি করা কয়লা থেকে। কিন্তু এখন কয়লা আমদানির ডলার জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি।
কয়লা সংকটের কারণে পুরোপুরি বন্ধ আছে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ। দুটি ইউনিট মিলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া বরগুনার আমতলী এলাকার ৩০৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ আছে। গত ২৭ অক্টোবর থেকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অংশ হিসেবে এটি বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি বাংলাদেশকে বলে আসছে। আদানি কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা পিডিবির কাছে ৮৫ কোটি ডলারের বেশি অর্থ পায়। এরই মধ্যে বকেয়া পরিশোধে তারা চাপ তৈরি করেছে। গত ৩১ অক্টোবর আদানির একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি কর্তৃপক্ষ। অন্য ইউনিট থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত এসেছে ৬২২ মেগাওয়াট। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এ ছাড়া পটুয়াখালীর পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে এখন প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এটি রক্ষণাবেক্ষণে সময় লাগবে দুই মাস। এ ছাড়া বাগেরহাটের রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদন শুরুর পর যান্ত্রিক ত্রুটির পাশাপাশি কয়লা সংকটেও পড়েছে বেশ কয়েকবার। বর্তমানে রামপাল থেকে প্রায় ৬০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী এসএস পাওয়ার ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু আছে। এ কেন্দ্র থেকে গত শনিবার পর্যন্ত ৬০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। জানা যায়, বকেয়া বিল বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে কয়লার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা চলে আসছে। আগামী ২১ বা ২২ নভেম্বরে এই কয়লা চলে আসবে। আশা করছি চলতি মাসের ২৪ বা ২৫ নভেম্বরের মধ্যে এই কেন্দ্র চালু হয়ে যাবে। আর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এ সময়ে রুটিন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যায়। এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো রুটিন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যায়। আদানি কর্তৃপক্ষ এখন দুটি ইউনিটেই বিদ্যুৎ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় আমাদের এখন অতিরিক্ত বিদ্যুতের দরকার নেই। আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী আদানি কর্তৃপক্ষকে পেমেন্ট দিচ্ছি। এটা নিয়ে মাথাব্যথার কোনো ব্যাপার নেই।