চুরি সিস্টেম লসে ডুবছে বিদ্যুৎ খাত

শামীম আহমেদ

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন (আমদানিসহ) হয়েছে ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা)। এর মধ্যে ৮ হাজার ৯১২ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎই গচ্চা সিস্টেম লসের খাতায়। চুরির মাধ্যমে বিদ্যুৎ লুটপাট করে দেখানো হচ্ছে সিস্টেম লস হিসেবে। গ্রাহকের কাছে প্রতি ইউনিট বিক্রয়ের গড় মূল্য ৭ টাকা ৬২ পয়সা (ডিমান্ড চার্জ ছাড়া ডেসকোর বিক্রয় দর) ধরে অপচয় হওয়া বিদ্যুতের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার ৭৯০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রতিদিন নষ্ট হয় ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার বিদ্যুৎ। এর সঙ্গে বেসরকারি অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জ ও অন্যান্য ভর্তুকি যোগ করলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ। দিন শেষে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ক্ষতি চাপছে গ্রাহকের ঘাড়ে। শুধু চুরি ঠেকাতে পারলেই বছরে অন্তত ২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বাঁচানো যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে গত ১ মার্চ নতুন দাম কার্যকর হওয়ায় দুই মাসের ব্যবধানে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ল তিনবার। ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এ নিয়ে চলছে সমালোচনা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে বসিয়ে বসিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জ দিতে গিয়ে খালি হচ্ছে রাজকোষ। অন্যদিকে সিস্টেম লসের নামে সারা দেশে বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব চলছে। ক্ষতি পোষাতে বিদ্যুতের দাম এমন ঘন ঘন বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ১৯৬০ সালে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণে বিশ্বের গড় সিস্টেম লস ছিল ৯ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে কমে দাঁড়ায় ৮ শতাংশে। স্টাটিসটা ডটকমের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩ শতাংশ, জার্মানি ও জাপানে ৪ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ও চীনে ৫ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে ৬ শতাংশ ছিল সিস্টেম লস। জাপান ইলেকট্র্রিক পাওয়ার ইনফরমেশন সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, মধ্য জাপানের চুবু অঞ্চলে ১৯৫০ সালে সিস্টেম লস ছিল ২৫ শতাংশ, ২০২০ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৪.২৯ শতাংশে। অথচ বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেও সিস্টেম লস দাঁড়ায় ১০.৪১ শতাংশে।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বিদ্যুতে সিস্টেম লস ছিল ১৪.৬১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৪১ শতাংশে। এর মধ্যে সঞ্চালন লস ছিল ২.৮৯ শতাংশ। আগের বছরের ব্যবধানে সিস্টেম লস শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে এবং ২১ বছরের মধ্যে এটা সর্বনিম্ন। এই সময়ে শুধু ডেসকোর সিস্টেম লস ৫.৫৮ থেকে বেড়ে ৫.৬২ শতাংশ হয়েছে। অন্য বিতরণ সংস্থাগুলোর সিস্টেম লস যথাক্রমে নেসকোর ৯.৯২ শতাংশ, আরইবির ৯ শতাংশ, বিপিডিবির ৮.১০ শতাংশ, ওজোপাডিকোর ৭.৪৪ শতাংশ, ডিপিডিসির ৬.১৩ শতাংশ হলেও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণে টেকনিক্যাল সিস্টেম লস ৬ শতাংশের মধ্যে থাকলে তাকে সহনীয় ধরা যায়। দীর্ঘ লাইন, কম ভোল্টেজে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ, বেশি রোধের মানহীন চিকন তার ও নিম্নমানের সরঞ্জামের কারণে সিস্টেম লস বাড়ে। তবে দেশের সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো অনেক দিন ধরেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বলে জানিয়ে আসছে। সরকারও অঢেল বরাদ্দ দিচ্ছে। প্রযুক্তি আনা হচ্ছে জাপান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে। চাহিদা অনুযায়ী সাব-স্টেশন নির্মাণ, ট্রান্সফরমার স্থাপনসহ বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, অনলাইনে মিটার রিডিং গ্রহণ, প্রিপেইড মিটার স্থাপনসহ নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরও সিস্টেম লস আশানুরূপ কমেনি। চুরি বন্ধ করতে পারলে হয়তো সিস্টেম লস ৬ শতাংশে নামত। তাহলে বছরে প্রায় ২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকার বিদ্যুৎ বাঁচানো যেত।
এদিকে অন্যান্য বিতরণ সংস্থার তুলনায় ঢাকার দুই সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকোর সিস্টেম লস কাগজে-কলমে কম থাকলেও খোদ রাজধানীতেই বিতরণ সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রকাশ্যেই চলছে বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব। তথ্য বলছে, রাজধানীর ফুটপাতে থাকা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ অস্থায়ী দোকানে জ্বলছে অবৈধ বৈদ্যুতিক বাতি। পল্টন, গুলিস্তান, মিরপুরে প্রকাশ্যেই বিদ্যুতের লাইনে হুক লাগিয়ে বাতি জ্বালাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া অলি-গলিতে সড়কের পাশে গড়ে ওঠা মাংসের দোকান, চায়ের দোকান, ফুচকা-চটপটির দোকানেও জ্বলছে মিটার ছাড়া বাতি। এসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এলাকাভেদে বাতিপ্রতি তারা দিনে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের ২০-৪০ টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। বিদ্যুৎ চুরিকে কেন্দ্র করে শুধু রাজধানীতেই দিনে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা, যার কানাকড়িও পাচ্ছে না সরকার। ব্যাটারি চার্জের জন্য সারা দেশে যেসব স্টেশন গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশই অবৈধ সংযোগ বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

রাজধানীর বিদ্যুৎ গ্রাহকরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এলাকার চিহ্নিত দালাল চক্র ইচ্ছামতো আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে আয় করছে। এ কারণে অনেক এলাকায় কাগজে-কলমে থাকা চাহিদার চেয়ে প্রকৃত চাহিদার ব্যবধান অনেক বেড়ে যাওয়ায় প্রায়ই ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। ভোল্টেজ ওঠানামা করছে। আবার মাস শেষে ভুতুড়ে বিলও আসছে। ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্যও রাজধানীর গ্রাহকদের বেশি দিতে হচ্ছে। চুরির ক্ষতি সামাল দিতে ভুতুড়ে বিল দিয়ে হয়রানি ও বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে ধারণা তাদের।

এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ভোক্তা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্মুক্ত দরপত্র এড়িয়ে আইন করে ইচ্ছামতো ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয়, সঞ্চালন-বিতরণ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। বিইআরসির হিসাব অনুযায়ী- বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয়ের ওপর ৫ শতাংশের কিছু বেশি মুনাফা পেতে পারে। সেখানে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১৮ শতাংশ লাভও দেওয়া হয়েছে। এর ওপরে চুরি হচ্ছে। কাগজে-কলমে সিস্টেম লস যা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তা আরও বেশি। বিদ্যুৎ কত ইউনিট বিক্রি হচ্ছে এবং কত টাকার বিল আদায় হচ্ছে তার সঠিক হিসাব নেই। সর্বত্র স্মার্ট মিটার রিডিং নেওয়া হচ্ছে না। একেক সময় একেক বাড়ির মিটার রিডিং নিয়ে একটা গড়পড়তা হিসাব করে দেওয়া হচ্ছে। সিস্টেম লস কম দেখাতে ভোক্তাদের বিল বাড়িয়ে গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছে। এসবের ঘানি টানতে হচ্ছে মানুষকে। এখন নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী ভোক্তা যে বিদ্যুৎ কিনছে তার দাম ও মান যাচাই-বাছাই করার অধিকার তার আছে। রাষ্ট্র আইন দ্বারা সে অধিকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু ভোক্তার সেই অধিকার খর্ব করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights