দিনদুপুরেই দুই ব্যাংকে ডাকাতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও বান্দরবান প্রতিনিধি

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা ও লুটের ১৬ ঘণ্টার মাথায় এবার দিনদুপুরে থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। তারা ব্যাংক-কর্মীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ টাকা লুটে নিয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী দুটি গাড়িতে এসে পাশাপাশি থাকা কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক শাখায় হামলা চালায় বলে কৃষি ব্যাংকের থানচি উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক হ্লা সুই থোয়াই জানান। তিনি বলেন, ‘তারা এসে চোখের পলকে আমাদের ব্যাংকে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ফেলল। তারপর সবাইকে একটি কক্ষে নিয়ে বাইরে থেকে আটকে দিল।’ স্থানীয়রা জানায়, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে থানচি বাজারে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এসে দোকানগুলো থেকে মোবাইল সেট ও নগদ টাকা কেড়ে নেয় অস্ত্রধারীরা। পরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে ঢুকে ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকা লুটতরাজ করে চলে যায়। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জদান খান ঢাকায় বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের যা যা করার দরকার আমরা করব।’

স্থানীয় সূত্রগুলো জানান, অস্ত্রধারীদের মুখে মাস্ক ছিল। পরনে নব্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’-এর অনুরূপ ইউনিফর্ম ছিল। স্থানীয়রা জানায়, ব্যাংকে যারা ডাকাতির জন্য প্রবেশ করেছিল তার বাইরেও তাদের আরও লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। তারা বাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। থানচি বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আজ (গতকাল) থানচিতে সাপ্তাহিক বাজার। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন মালামাল নিতে এখানে এসেছিল। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তিনটি জিপে সন্ত্রাসীরা আসে। আমরা তিনটি গাড়িতে লোকজন আসতে দেখেছি। তার মধ্যে দুটি গাড়ি থেকে নেমে তারা দুই ব্যাংকে যায়। একটি গাড়ি ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।’ দুই ব্যাংকেই অনেক গ্রাহক ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকে প্রবেশ করে দলটির সদস্যরা ম্যানেজারকে খুঁজতে থাকে। না পেয়ে ক্যাশ বাক্সে থাকা টাকা নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে কয়েকজন নারীও ছিল জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘দলটির লোকজন খাকি পোশাক পরে ছিল। আমাদের ধারণা, তারা কুকি-চিন পার্টির সদস্য।’

ব্যাংক লুট শেষে সশস্ত্র দলটি থানচি বাজারে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে আতঙ্ক তৈরি করে এবং তিনটি জিপে চাঁদাপাড়া সড়কের দিকে চলে যায় বলে জানান ওই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, সিনেমায় যেভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ব্যাংক লুটের দৃশ্য দেখা যায়, এ দৃশ্যটাও এমন মনে হয়েছে তার কাছে।
স্থানীয় আরেকজন বলেন, ‘চাঁদাপাড়ায় নদীর পারে কয়েকদিন ধরে নাটকের শুটিং চলছিল। আমরা প্রথমে মনে করেছি সেই নাটকের কোনো শুটিং চলছে। তাই অনেকে প্রথমে বিষয়টা এড়িয়ে গেছে। পরে বাজারে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার যখন করল, তখন আমরা বুঝতে পেরেছি এটা ডাকাতি।’

বান্দরবানের থানচি বাজারে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির ঘটনায় ডাকাতরা ভল্ট খুলতে পারেনি বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুন। গতকাল দুপুর ২টার দিকে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫ লাখ এবং কৃষি ব্যাংক থেকে ৫-৭ লাখ টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতরা। তিনি আরও বলেন, ডাকাতরা ব্যাংকের ভল্ট খুলতে পারেনি। তারা কাউন্টারে রাখা ও গ্রাহকের উত্তোলন করা টাকা নিয়ে গেছে। ভীতি সৃষ্টি করতে ডাকাতরা ব্যাংকের ভিতরে ব্যাপক গোলাগুলি করেছে।

এর আগে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা ও ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে। তারা ব্যাংকের ম্যানেজারকেও অপহরণ করে নিয়ে যায়। গত রাত পর্যন্ত ম্যানেজারকে উদ্ধার করা যায়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম বিকালে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের থানচি শাখায় হামলার খবর পেয়েছি। পুলিশ, র?্যাব ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গেছে। তারা কাজ করছে।’ সোনালী ব্যাংক বান্দরবান অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ঘটনার পর এ অঞ্চলের ব্যাংকের সব শাখায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।’

গতকাল সকালে রুমার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন, পুলিশের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান, সোনালী ব্যাংক চট্টগ্রাম বিভাগের জিএম মুসা খান।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, স্থানীয়দের ধারণা এ ঘটনা নব্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ঘটিয়ে থাকতে পারে। থানচির ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আবদুল করিম বলেন, ‘আজ (গতকাল) থানচিতে ব্যাংকে হামলা হয়েছে। আমাদের ধারণা, গতকালের গ্রুপটিই এটা করেছে।’

পাহাড়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা বম পার্টি ওই ঘটনায় জড়িত বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। রুমার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার ভরদুপুরে থানচিতে দুটি ব্যাংকে হামলা ও টাকা লুটের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয় এক ব্যক্তির করা ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়েছে। ভিডিওতে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ সময় থানচি বাজারের লোকজন ভয় ও আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। অনেক নারী-পুরুষকে একটি ঘরে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। এ ঘটনার পর বাজার প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। রাস্তার পাশে ফুটপাতে কিছু দোকান খোলা অবস্থায় দেখা গেছে। গোলাগুলির সময় তারা দোকান খোলা রেখেই জান বাঁচাতে পালিয়ে যায়।

রুমা সোনালী ব্যাংকে হামলা ও ডাকাতির ঘটনার পর গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি ব্যাংকের পাশাপাশি পাশের মসজিদও পরিদর্শন করেন। ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে থানচির ব্যাংক ডাকাতি নিয়েও কথা বলেন আইজিপি। তিনি বলেন, ‘আমরা একটু আগেই বিষয়টি শুনেছি। আমরা সতর্ক ছিলাম বলেই তারা এসে পালিয়ে গেছে। আমরা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি।’ প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘যারা দুষ্কৃতকারী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

What do you like about this page?

0 / 400

Verified by MonsterInsights