পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ আসন্ন, আশঙ্কা পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র

ফারাজী আজমল হোসেন

পাকিস্তানের জাতীয় গণমাধ্যম ডনে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ আহমদ চৌধুরীর একটি বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা। সেখানে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতি ভেঙে পড়েছে। রাজনীতিবিদরা তবু সজাগ হননি। অর্থনীতি খাড়া ঢালে নেমে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদী বাহিনী পুনরুত্থিত হচ্ছে। তারপরও কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই ঠিক হয়ে যাবে’।

কিন্তু পাকিস্তানের রোগ যে সারবার নয়, সেটা ভালোই বুঝেছেন আইজাজ। তার মতে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং নিরাপত্তার হুমকি দেশটিকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই বাস্তববাদীরা উদ্বিগ্ন। তার সাফ কথা, পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কট একটি গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে।

ডনের সাম্প্রতিক একটি সম্পাদকীয়কে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, “…জাতি গৃহযুদ্ধের সাথে বিপজ্জনকভাবে রসিকতা করছে বলে মনে হচ্ছে। নিজস্ব দ্বন্দ্বের ভারে নিজেকেই ছিন্নভিন্ন করছি আমরা।”
তিনি নিজেই প্রশ্ন তোলেন, পাকিস্তান ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে? সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দিশা আদৌ আছে কি? জবাবে তার মূল্যায়ন, দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমবর্ধমান। তাই সার্বজনীন স্থানগুলোও নিয়মিত প্রতিবাদ, সংঘর্ষ এবং দাঙ্গার স্থান হয়ে উঠেছে।

তিনি মনে করেন, সামাজিক অস্থিরতা, নাগরিক অব্যবস্থা, অবাধ্যতা এবং ধর্মঘট স্বাভাবিক জনজীবনকে এখনই বিঘ্নিত করে তুলেছে। এভাবে চললে পাকিস্তান বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে বলেও তিনি মনে করেন।

সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সুদান বা রুয়ান্ডার মতো পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নেই, এমনটা ভাবা বোকামি হবে বলে মনে করেন পাকিস্তানের এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।

তার মতে, অসহিষ্ণুতার তীব্র সংস্কৃতি সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়। গৃহযুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল টেকসই রাজনৈতিক অস্থিরতা। সেখানে শাসক বা বিরোধী দল কোন সমঝোতা স্বীকার করতে ইচ্ছুক নয়। ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’-এর কোনো চেতনা ছাড়াই বহিরাগত শক্তির দ্বারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা সর্বদা সাধারণ জনগণকে বহন করতে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুদানের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ৪৬ মিলিয়ন মানুষ কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে ভুগছে। সম্প্রতি, দেশটি নিয়মিত সেনাবাহিনীর সামরিক নেতৃত্ব এবং একটি আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে একটি ভ্রাতৃঘাতী ক্ষমতার লড়াই প্রত্যক্ষ করেছে। পরিস্থিতি বিশৃঙ্খলার দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে লুকানো বিদেশী হাত গৃহযুদ্ধকে বাড়িয়ে তুললে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে সুদানের সাধারণ মানুষকে। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার বেসামরিক অস্থিরতার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। সশস্ত্র সংঘাতের জেরে সেখানে লক্ষ লক্ষ সিরীয় নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুতও হয়েছেন আরও কয়েক লক্ষ মানুষ। রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ডনে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটিতে। সেখানে হুতুস এবং তুতসিরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৯৪ সালে ১০০ দিনের মধ্যে গণহত্যার শেষ হয়েছিলেন ৮ লাখ মানুষ।

আইজাজ স্মরণ করিয়ে দেন, পাকিস্তানে যতবারই রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট দেখা দিয়েছে ততবারই তার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে সাধারণ জনগণকেই।

তার মতে, ১৯৭১ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফলকে সম্মান করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বেপরোয়া সামরিক অভিযানের সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে রক্তাক্ত বিচ্ছিন্নতার কথাও উল্লেখ করেন। নিন্দা করেন পাকিস্তানি বর্বরতার। সেই সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব কি ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে? আগামী দিনেও যে পারবে তার কি কোনও সম্ভাবনা আদৌ রয়েছে?

প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি টেবিলে বসে তাদের সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট সাহস ও ইচ্ছাশক্তি দেখাতে পারবে? আর সেটা না পারলে যে ফের একাত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে সেই আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকার চায় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করুক। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অবিলম্বে নির্বাচন চান। আইজাজের মতে, জুন এবং অক্টোবরের মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান নিয়ে উভয় পক্ষের এতো কঠোর অবস্থান ঠিক নয়।

ডিপ্লোম্যাটিক ফুটপ্রিন্টসের লেখক আইজাজের মতে, পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও একটি নতুন সামাজিক চুক্তি এবং আচরণবিধিতে সম্মত হওয়া উচিত। সেই চুক্তির শর্তগুলি হচ্ছে, ‘সামরিক সংস্থা তার অরাজনৈতিক থাকার অভিপ্রায় ঘোষণা করবে। অযথা তাদের রাজনীতিতে টেনে আনার প্রয়োজন নেই। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে সকলের সম্মান করা উচিত। নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করা চলবে না এবং প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়মুক্তির সাথে ব্যবহার করাও বন্ধ করতে হবে’।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। তার মতে, নির্বাচনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য তারিখ বেছে নিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একমত হতে হবে। বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য সমঝোতায় লজ্জার কোনও জায়গা নেই বলেও তিনি সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝাবার চেষ্টা করেন। তার মতে, একটি সমঝোতা প্রতিটি দলকে খুশি নাও করতে পারে, তবে এটি অবশ্যই পাকিস্তানের জনগণকে শাসন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরাতে সাহায্য করবে।

কিন্তু লেখক নিজেই জানেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামরিক ও বিচারবিভাগীয় নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কখনওই রাষ্ট্রের উন্নয়নে একমত হবেন না। তাই পাকিস্তান যে গৃহযুদ্ধের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে সেটা সেদেশেরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত পাকিস্তানের বিশিষ্ট নাগরিকদের লেখাতেই বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। জঙ্গিবাদীদের মদদ জুগিয়ে এখন পাকিস্তান নিজেই জঙ্গিবাদের নিশানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তালেবানরাও পাকিস্তানকে হুমকি দেয়। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতারা ব্যস্ত নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে। সামরিক শক্তি ক্ষমতার আস্ফালনে মগ্ন। বিচার ব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া দেশটি আরও কঠিন পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে বলে পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরাই আশঙ্কা করছেন।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি নতুন সামাজিক সংহতি এবং আচরণের নিয়মের বিষয়েও একমত হওয়া উচিত। যেমন :সামরিক সংস্থা তার অরাজনৈতিক অভিপ্রায়ের কথা ঘোষণা করেছে এবং এটিকে রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত নয়; সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে সবার সম্মান করা উচিত; নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করা যাবে না এবং প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়মুক্তির সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত নয়। অর্থাৎ, জবাবদিহি থাকতে হবে। নির্বাচনের জন্য সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একটি তারিখের বিষয়ে একমত হতে হবে। বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য সমঝোতায় আসার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। একটি সমঝোতা প্রতিটি দলকে খুশি না-ও করতে পারে, তবে এতে অবশ্যই পাকিস্তানের জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, যারা এই শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখছে এবং আস্থা হারাচ্ছে।

তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী জালমে খলিলজাদ বলেছেন, পাকিস্তানে সামরিক ও বিচার বিভাগের ভেতরে রাজনীতিকীকরণ চরমে উঠেছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পাকিস্তান নামের দেশটি ও তার জনগণের জন্য হবে একটি ট্র্যাজেডি। এর অর্থনীতি ধসে পড়বে, দারিদ্র্য আরও বাড়বে। সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে জীবনকে করে তুলবে অতিষ্ঠ। ফলে সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একটা সমাধানে আসতে হবে। এজন্য সবাইকে ইতিবাচক মানসিকতা ধারণ করতে হবে। তা না হলে যে পরিস্থিতি হবে সেটির দায় কেউই এড়াতে পারবেন না। আর সেটির সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পাকিস্তানের জনগণ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights