পাচার হওয়া অর্থের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন

নিরঞ্জন রায়

বিদেশে অর্থপাচার নিয়ে আমাদের দেশে আলোচনা দীর্ঘদিনের। দুই দশকের বেশি সময় ধরে শুনে আসছি যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের বিরুদ্ধেই বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে এই অভিযোগ অনেক বেশি। এর কারণও আছে। বিগত সরকার দেড় যুগের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল, ফলে তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ অনেক বেশি ও লম্বা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। বিশেষ করে বিশাল বিশাল অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে।

নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে বিশাল অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থই বিদেশে পাচার হয়েছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে, আগের সরকারের সময় অর্থ পাচার হওয়া নিয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠা এবং ব্যাপক আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও এই অপরাধ বন্ধ করতে সেই সরকারকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি। আবার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অনেক আলোচনা করলেও সেই অর্থ ফিরিয়ে আনতে হলে যে ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হয় সেটিও আমরা লক্ষ করছি না।

বিষয়টি আলোচনা, দুদক ও এফআইইউর (ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। বড়জোর গভর্নর কিছু কঠোর কথা বলেছেন, কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশে পত্র প্রেরণের ঘোষণা দিয়েছেন। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে আশাবাদী হওয়া বেশ কঠিন। কেননা পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়, তা এখনো শুরুই হয়নি। তা ছাড়া বাস্তবতা হচ্ছে, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কাজটা আসলে দুঃসাধ্য। তা না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহা ক্ষমতাধর দেশ তাদের দেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে রাখা শত শত বিলিয়ন ডলার অনেক আগেই ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হতো।

পাচার হওয়া অর্থের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজনবিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, সে তুলনায় সঠিক তথ্য আমরা পাইনি। অর্থ অবশ্যই পাচার হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। কিন্তু যে তথ্যটা জনসমক্ষে আসেনি তা হচ্ছে, কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ অর্থ কোন বছর কোন দেশে কিভাবে অর্থাৎ ব্যাংক না হুন্ডির মাধ্যেম পাচার করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঢালাও অভিযোগ আনা হয়েছে যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসব বক্তব্য যে শুধু রাজনৈতিক মহল থেকে এসেছে তেমন নয়, অনেক পেশাদার সংস্থা থেকেও একই রকম অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) ও টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) একইভাবে বলে আসছে যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ রকম ঢালাও বক্তব্য দিয়ে দেশ থেকে অর্থ পাচারের গুরুতর অভিযোগকে হালকা করে ফেলা হয়।

রাজনৈতিক বক্তব্য এ রকম হতেই পারে। কেননা রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া হয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এবং জনগণকে নিজেদের পক্ষে টানার উদ্দেশ্যে। ফলে সেই বক্তব্য যে সব সময় তথ্যনির্ভর হয়, তেমন নয়। কিন্তু পেশাদার সংস্থা থেকে যখন অর্থপাচারের মতো অভিযোগ আনা হবে, তখন সেটা অবশ্যই তথ্যনির্ভর হতে হবে। তাদের কাছে সঠিক তথ্য থাকতে হবে যে কোন বছর কোন কোন ব্যক্তি কত টাকা কিভাবে কোন চ্যানেলে অর্থাৎ ব্যাংক না হুন্ডির মাধ্যমে কোন দেশে পাচার করেছে। সেই তথ্য টিআইবি ও সিপিডির কাছে তাদের অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে থাকা বাঞ্ছনীয়। শুধু তা-ই নয়, তাদের কাছে এই তথ্যও থাকতে হবে যে পাচার হওয়া অর্থ কোথায় কিভাবে আছে, অর্থাৎ বিশ্বের কোন ব্যাংকে গচ্ছিত আছে বা কিভাবে বিনিয়োগ করে রাখা হয়েছে। এসব তথ্য নিয়ে যখন পেশাদার প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করবে, তখন সেসব অভিযোগ একদিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে, অন্যদিকে তেমনি এই অভিযোগের ভিত্তিতে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনাও সম্ভব হবে।

একজন পেশাদার ব্যক্তি বা সংস্থা কিভাবে অর্থপাচারের মতো অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে পারে তা জানতে হলে আমাদের গ্যাব্রিয়াল জাকম্যানের লেখা ‘দ্য হিডেন ওয়েলথ অব নেশনস’ বইটি পড়া উচিত। সেই বইয়ে লেখক স্পষ্টভাবে এবং তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের কোন কোন দেশ থেকে কারা কী পরিমাণ অবৈধ অর্থ অন্যত্র গোপন আস্তানায় সরিয়ে রেখেছে। বিষয়টি নিশ্চিত এবং পরিষ্কার। শুধু এ বইয়ের কথা বলি কেন, ক্যারিবীয় দ্বীপ দেশের কথা কমবেশি সবারই জানা।

ক্যারিবীয় দ্বীপ দেশ হচ্ছে অবৈধ এবং পাচার হওয়া অর্থ জমা রাখার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সেসব দ্বীপ দেশে অসংখ্য শেল কম্পানি গড়ে উঠেছে, যেখানে শুধু অবৈধ অর্থ জমাই রাখা হয় না, সেখান থেকে অবৈধ অর্থ বৈধ করারও সুব্যবস্থা আছে। উল্লেখ্য, শেল কম্পানি হচ্ছে এমন এক ধরনের প্রতিষ্ঠান, যা কাগজে-কলমে থাকলেও এর অবস্থান খুঁজে পাওয়া কষ্টকর এবং এর পেছনে কারা আছে তা-ও জানার উপায় নেই। বেশির ভাাগ ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাই এসব শেল কম্পানির মালিক এবং তারাই এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। এখন অনেকেই ভাবতে পারেন যে এ রকম সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা সত্ত্বেও আমেরিকা বা অন্যান্য উন্নত দেশ কেন সেই অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারছে না? উত্তর একটাই, তা হচ্ছে আইনের সীমাবদ্ধতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ফিন্যানশিয়াল টাইমস পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যে বিগত সরকার বাংলাদেশ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এ প্রসঙ্গে গভর্নর এটাও বলেছেন যে কিভাবে এই অর্থ পাচার করা হয়েছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যাংক অধিগ্রহণের সময় নতুন অংশীদারদের ঋণ এবং আমদানি খরচ বেশি দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে ১৬.৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। এই প্রথম বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য দিলেন, যা এই মুহূর্তে খুব বেশি প্রয়োজন। অবশ্য এই অর্থ দেশের কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিশ্বের কোন কোন দেশে পাচার করে কোন কোন ব্যাংকে জমা রেখেছেন, সেই তথ্য তিনি উল্লেখ করেননি। আমাদের বিশ্বাস, এই তথ্য তার কাছে নিশ্চয়ই আছে। এখন সেই তথ্যের সূত্র ধরে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলেই দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

গভর্নরের সুনির্দিষ্ট বক্তব্যের কয়েক দিন পরই টিআইবির প্রধান এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করে বলেছেন যে বিগত সরকার বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। অর্থাৎ আমরা যদি বিগত ১০ বছরের শাসনামল বিবেচনায় নিই, তাহলেও দেখা যাবে যে এই সময়ে দেশ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। বছরে যদি রপ্তানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার হয়, তাহলেও মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ টিআইবির ভাষ্য অনুযায়ী বিদেশে পাচার হয়েছে। পরিমাণটি বিশাল। বাংলাদেশের রপ্তানির বেশির ভাগ তৈরি পোশাক, যা আমদানি করে বিশ্বের খ্যাতনামা সব প্রতিষ্ঠান, যাদের আছে নিজস্ব কঠোর কমপ্লায়েন্স পদ্ধতি। এমনকি তৈরি পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়; এবং এর মান ও কঠোরতা আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর চেয়ে অনেক উন্নত। এসব কমপ্লায়েন্স ভেদ করে রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করার কাজটি শুধু কঠিনই নয়, বলা চলে প্রায় অসম্ভব। কেননা এই ধরনের কাজে সহযোগিতার প্রমাণ পেলে বিশাল অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে আমেরিকার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। কিছুদিন আগে এ রকম কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে থাইল্যান্ডের এক প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে। এসব কারণে বিভিন্ন মহল থেকে যেভাবে অর্থপাচারের অভিযোগ করা হয়, তার হিসাব মেলানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

যা হোক, টিআইবির প্রধান যেহেতু প্রকাশ্যে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ১০ বছরে ১৫০ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচারের অভিযোগ করেছেন, তাই তাদের কাছে এই অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নিশ্চয়ই আছে। কেননা টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান, যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা নিশ্চয়ই আন্দাজে কথা বলবে না। তাই তাদের প্রধান কাজ হবে এই ১৫০ বিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য-প্রমাণ অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। এর ফলে তাদের কাজটা অনেক সহজ হবে এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ খুব দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নিয়ে কাজ করার ফলে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের পাচার হওয়া অর্থ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে এবং এ রকম দৃষ্টান্ত যে একেবারে নেই, তেমন নয়। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে সঠিকভাবে এগোতে না পারলে পাচার হওয়া অর্থ তো ফেরত আনা সম্ভব হবেই না, উল্টো দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ভাবমূর্তির সংকটে পড়তে পারে। আর এ কারণেই দেশ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচারের যে অভিযোগ তা সুনির্দিষ্ট ও তথ্য-প্রমাণভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights