ফিচার: যেমন কাটছে জবি শিক্ষার্থীদের শীত ঋতু
চলছে মাঘমাস। চারিদিকে শীতের আমেজ৷ দেশের কোন কোন অঞ্চলে তাপমাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছেছে। হাড় কাপানো শীত। শহরের সে শীতের আমেজের পুরোটা পাওয়া না গেলেও কনকনে শীত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দুরন্ত শৈশব। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলা। কতো রকম বাহারী পিঠার সমাহার। কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা সূর্যটা যখন উঠবে ঠিক তখনই মা-দাদির বানানো উষ্ণ ভাপা পিঠার স্বাদ যেন এখনও জিহবাতে লেগে আছে। এই সব হাজারো শীতের স্মৃতি জড়ো হয়ে থাকে পড়াশোনার উদ্যেশ্যে গ্রাম ছেড়ে আসা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মনে। তারই কিছুটা প্রকাশ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অনুভূতিগুলো তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ও আলোচিত বাংলাদেশের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি জুনায়েদ মাসুদ।
শীত ঋতু সবার জন্য হোক উপভোগ্য
আমাদের দেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাস পরপর এই ঋতুর পালাবদল হয়। শীত আমাদের পঞ্চম ঋতু। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। হেমন্তের শেষে সোনালি ডানায় ভর করে ঠান্ডা বাতাসকে সাথে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে শীত। শীতের কথা স্মরণ করলেই চোখের সামনে ভেসে আসে কুয়াশার চাদরে আবৃত চারপাশ। শিশিরে ভেজা সোনালী সকাল। ঠান্ডা হিমেল বাতাসে কাঁপতে থাকা শীতার্ত মানুষের পথচলা।সারি সারি খেজুরগাছে ঝুলতে থাকা রসের ভাঁড়। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত রসের ভাঁড়ে মৌমাছিদের নৃত্য, পাকিদের রই খাওয়ার দৃশ্য। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরের উপর রোদ পড়লে মনে হয় মুক্তা জ্বলছে।ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর নয়নাভিরাম দৃশ্য। শীতের সকালের রোদ খুব মিষ্টি লাগে তখন সূর্যের তাপ কম থাকে। শীতের সকালে ভাপা, পুলি, নকশি, দুধ পুলি, পাটিসাপটা সহ আরো নানা ধরনের বৈচিত্র্যর পিঠা পাওয়া যায়।
শীতকালে অনেক সবজি পাওয়া যায়। কৃষক তার
ব্যাস্ত সময় পার করে ফসল তোলায়। প্রকৃতি সেজে উঠে নতুন রূপে। শীতের সময় ধনী ব্যাক্তিরা উপভোগ করলেও গরিবদের জন্য শীতের সময় অনেক কষ্ট হয়, অনেক সময় তারা গরম কাপড় পরতে পারে না। তারা চাতক পাখির মতো কখন সূর্য উঠবে সেই প্রত্যাশায় থাকে। সূর্যের তাপে শীত কমাবে।
অসহায় মানুষের জন্য শীতকাল অনেক কষ্টের হলেও অনেকেই এই ঋতু পছন্দ করে।
মিজান উদ্দিন মাসুদ
রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ
শীত ঋতু বাঙালি মনে নতুন উৎসব
শীতকাল এলেই বাতাসে মিশে থাকে রুক্ষতা ও শীতল গন্ধ। গাছের পাতারা প্রাণ হারিয়ে ফেলে নতুন প্রাণের আশায়। শীতকাল যেন নতুন আগমনী বার্তা নিয়ে আসে পৃথিবীর বুকে। বাংলা পৌষ-মাঘ দুই মাস মিলে শীতকাল হলেও এবছর শীতের আমেজ শুরু হয়েছে ২০২৩ এর ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই। রাজধানী ঢাকায় শীত কম হলেও বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যেই তীব্র শীত পড়া শুরু হয়েছে। এই তীব্র শীতে গ্রামে মাটির চুলার পাশে বসে গরম গরম ধোয়া ওঠা পিঠা খাওয়া, তীব্র শীতের সকালে খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা টাটকা খেজুর রস এবং শীতের টাটকা সবজি খাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে শীত কাল যেন একটা উৎসব বয়ে আনে প্রত্যেকের মনে। শীতকালীন ছুটিতে শীতের এই আমেজকে উপভোগ করতে ক্যাম্পাস ছেড়ে শেকড়ের টানে পাড়ি জমিয়েছিল অনেক শিক্ষার্থী।শীত চলে যাচ্ছে রিক্ত হস্তেই সাথে সাথে ফুরিয়েও গেছে শীতকালীন বন্ধ। শিক্ষার্থীরা আবার ফিরছে ক্যাম্পাসে সাথে নিয়ে আসছে গ্রামে পরিবারের সাথে কাটানো সোনালি স্মৃতিগুলো।
সোহানা চৌধুরী
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
পিঠাপুলির অনন্য এক ঋতু শীতকাল
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ । এই ছয়টি ঋতুর মধ্যে শীতকাল একটি।নলেন গুড়ের গন্ধ ভাসে বাতাসে; পৌষ পার্বণে পিঠে পায়েসের সাড়া পড়ে ;প্রকৃতি জানান দেয় শীত পড়েছে এবারে। এই শীতকালে সাধারণত আমরা নানা ধরনের পিঠা পুলি রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকি। শীতকালে কুয়াশায় চারদিক ঢাকা থাকে দেখতে অপরুপ সৌন্দর্য লাগে । এই প্রকৃতি সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। গেরুয়া রঙের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আমরা পরে থাকি। শীতের কোনো প্রাণোচ্ছল রূপমাধুরী নেই, সে রিক্ত ,ধ্যানমগ্ন মহাতাপস। মৃদু রোদের তাপ ও শিশির ঝরা রাত নিয়ে শীত আসে উদাসী সন্ন্যাসীর বেশে। আসলেই তাই এই শীতে আমরা কতই না আয়োজন করি তবে আমাদের পাশের জন শীতের আমেজ পাচ্ছে কি না রাখছি তার খোঁজ। রাখছি না খবর কাপড়, কম্বলহীনা মানুষদের কথা। তাই আসুন আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে দাড়ায় বস্রহীনা ভাইদের পাশে।
ইকাবাল হোসেন
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
শিশির ভেজা আর অরুণ রাঙা শীতের একটি সকাল
গুটি গুটি পায়ে চলতে চলতে আমরা আজ পুরোদস্তুর যান্ত্রিক। আমাদের শহুরে জীবনে শীত একটু ভিন্ন রকমের। আমাদের শীতের সকাল শুরু হয় না কোনো অতিথি পাখির ডাক শুনে। বরংচ আমাদের শীতের সকাল শুরু হয় রোজকার সেই গাড়ির হর্ণ আর হাজারো ব্যস্ততা দিয়ে। তাও অন্যসব ঋতু থেকে এই শীত কাল আমার বড্ড পছন্দের। শীতের কুয়াশায় ভেজা গাছগুলোর পাতা চুয়ানো জলের পরস আমায় বারংবার আকৃষ্ট করেছে। আমি সাধারণত খুব ভোরে উঠে যাই। আজ সকালের ই কথা। তখন বাজে ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা সেইসময় অবদিও সূর্য তার অন্তপুরের বিশ্রাম ছেড়ে উকি মারার সাহস করে নি। মেঘেরা সদলবলে কুয়াশা চাদর বিছিয়ে চলেছে সমগ্র আকাশ জুড়ে।দূরের উচু দালানের ছাদটা আজ বড্ড অস্পষ্ট। সমগ্র আকাশে যেন ধোয়া আর ধোয়া। এরকম এক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে মনোরম দৃশ্য হচ্ছে চড়ুই পাখির এক ঝাক চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাওয়া।আমার বাড়ির পাশেই আছে একটি বহুপ্রাচীন দিঘী। সেই নানুয়াদিঘীর ঘোলা জলে পাতিহাঁস ভাসতে দেখার কল্পনা করতে না করতেই দেখি একজোড়া পাঁতিহাস সাতার কাঁটছে দিঘীর জলে। আমরা যারা শহুরে মানুষেরা আছি তারা সত্যকার অর্থে শীতের সৌন্দর্য উপলব্দিই করে উঠতে পারি না। আমরা হয়ে উঠেছি যান্ত্রিক। আর আমাদের শীত উদাপন শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপলোড দেয়াতেই সীমাবদ্ধ।শহুরে জনজীবনের কর্মব্যস্ততায় আমরা আমাদের শেকড় ভুলে যাচ্ছি নাতো। সেই পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম, আর আগুন জ্বালিয়ে তাপ নেয়া কোথায় যেন শহরের যান্ত্রিকতায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে আমার শীত অতটাও রসকস ছাড়া যাচ্ছে না। কারণ আমরা আমাদের শেকড় ভুলতে বসলেও মা আমাদের ভুলতে দেন নি। মায়ের হাতে তৈরি পুলি, মালপোয়া, পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি আর খোলা পিঠা খেয়ে ভালোই যাচ্ছে এই শীতটা।
স্পর্শ বনিক
শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
এসো শীত, তোমার আবেশে ভেসে যাই
শীতের মেঘ লোকানো আকাশ , ঠান্ডা বায়ুতে কাপড় মোড়ানো শরীর, সবুজের রঙিন পৃথিবী , বিচরণ করে নানা রকমের অতিথি পাখি আর রয়েছে বছরের শীতকালীন ছুটি। আহা! মনে বলে হারিয়ে যায় এসবের মাঝে ,,, তবু কেন এসব হারিয়ে যায় । প্রকৃতি কি এসব বিষয়কে স্থির করতে পারে না ,,, তাহলে আমরা পেতাম ভোর ভোর গায়ে চাদর জরিয়ে খেজুরের রস খাওয়ার স্বাদ , এসব অনুভূতির মাঝে কিছু কিছু বিষয় নজর কাড়ে যেমন আমাদের মুরগি গুলো কত সুন্দর তার বাচ্চাগুলোকে তার ডানা দিয়ে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে আর বাচ্চাগুলো পেয়ে যায় এক উষ্ণতা। ঠিক এভাবেই ছোটবেলাই আমাদের মা আমাদের বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতো।
নিরব চৌধুরী
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
শীত যেনও আমার শৈশবে গাঁথা।
শীত ছিল আমাদের নিকটাত্মীয়ের মতো। অনুভূতির খুব কাছাকাছি এসে জড়ো হয়ে থাকত। তবে এই নিকটাত্মীয়কে বরং আশ্রয় না দিয়ে বিদায়ী সম্ভাষণ জানানোতেই বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতাম! খুব সকালে ঘুম-কুয়াশার সকালে গাদা থেকে আঁটি আঁটি খড় জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে শীত পোহানোর যে কী মজা, শৈশবে কানায় কানায় তা উপভোগ্য করে তুলেছিলাম। আগুনের উত্তপ্ত ধোঁয়ার তাড়া খেয়ে কুয়াশার বরফ জমাট ধোঁয়ার চোরের মতো পিঠ বাঁচিয়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের চেয়ে আনন্দের দৃশ্য আর কয়টাই বা ছিল তখন? আগুনের চারপাশে একদিকে ঠকঠক করে কাঁপছি, অন্যদিকে আরও জমাট শীতের কামনা মনে মনে। কারণ, জমাট শীত ছাড়া আগুন পোহাতে মজা কম! শীত যত বেশি, আগুনের উত্তাপের ঘনিষ্ঠতা ততই নিকটতম, লেপ-কম্বলগুলো অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। অথচ শীত ছাড়া ওরাও অর্থহীন।
এখনো আমাদের এই শহরে শীত পড়ে। বরফরঙা কুয়াশায় ঘাড় নুইয়ে পরাজিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে গাছগুলো, ঘাসগুলো। খুব ভোরে কোনো মাকড়সা জেগে উঠে হয়তো দেখে, তার পাতা জাল ভিজে সারা! ঘাসগুলোও সারারাত ভিজে ভিজে যেন কবিতাময় হয়ে থাকে। ঘাস ছুঁলেই শিহরিত অনুভূতিতে বের হয়ে আসবে একেকটা চমকানো কবিতা! তবে এসব কবিতা এখন আর শোনা হয় না। কর্মব্যস্ততার সিঁড়িতে পা রাখার পর থেকে আবেগের জায়গা কই। শীত আর অনুভূতির আবেগ—সে তো কোনো এক কাল্পনিক অগ্নিতাপে ধোঁয়া হয়ে ফেরারি হয়েছে কবেই!
শীতের প্রকৃতি যেনো রূপকথার রাজ্য থেকে তুলে আনা কোনো জীবন্ত ছবি। শীতে সর্ষে হলুদ এই গালিচা মনের অজান্তেই ইচ্ছে জাগায় দুরন্তপনার। পলকেই এমন সৌন্দর্যে বুঁদ হন পথচারী। কিন্তু কৃষকের বেঁচে থাকার লড়াইটা চলে রাত-দিন।ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা চারদিক। শুষ্ক আর হিমশীতল অনুভূতিতে প্রকৃতির রুক্ষ মূর্তি। শীতের প্রকৃতি বিবর্ণ হলেও থেমে নেই জীবিকার তাড়না। বৈরি আবহাওয়ার তিক্ততা তাই বিষাদে রূপ নেয় সাধারণের।
তুবা তাবাসসু তালহা
ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন
১৮ তম আবর্তন
ধন্যবাদ জানাই জুনায়েদ ভাইয়াকে, ধন্যবাদ জানাই আলোচিত বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমকে যে আমার কিছু কথা তুলে ধরেছেন।