মেয়াদোত্তীর্ণ রক্তে চলে ব্লাড ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বহুতল ভবনের নিচতলায় ‘সেইফ ব্লাড ব্যাংকের’ ব্যানার টানানো। দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ছোট্ট একটি রুমে চলছে ব্লাড ব্যাংক। সাধারণ রেফ্রিজারেটরে রাখা হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপের রক্তের ব্যাগ। সেখানে নেই রক্ত সংগ্রহ করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা। ও পজিটিভ গ্রুপের রক্ত চাইলে দেখা যায়, ব্যাগের গায়ে রক্তের মেয়াদের তারিখ সিল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। রিসিপশনে দায়িত্বরত ওমর ফারুক নামের কর্মকর্তা বলেন, ‘ছোট পরিসরে আমরা ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা করছি। এ জন্য সেরকম যন্ত্রপাতি নেই। অন্য ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহ করে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে থাকি।’ রক্তের মেয়াদ সিল দিয়ে ঢাকা কেন আর এই ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রক্তের ব্যাগে সিল আগের হাসপাতাল দিয়েছে, আমরা দেইনি। এই ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন আছে তবে লাইসেন্স নবায়ন করা নেই।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ক্লিনিক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নামের কোনো ব্লাড ব্যাংক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কখনো অনুমোদনের আবেদনই করেনি, লাইসেন্স নবায়ন তো দূরের কথা। শুধু এই ব্লাড ব্যাংক নয় সিন্ডিকেটের জালিয়াতির মাধ্যমে রাজধানীজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫ শতাধিক ব্লাড ব্যাংক। সরকারি হাসপাতালের মেয়াদোত্তীর্ণ রক্তের ব্যাগ ফেলে দিলে টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ডবয়, আয়া কিংবা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে কিনে নেয় এই ব্লাড ব্যাংকগুলো। এরপর মেয়াদ মুছে দিয়ে বিক্রি করে মুমূর্ষু রোগীর স্বজনদের কাছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেয়াদোত্তীর্ণ রক্তে চলে বকশী বাজার, চানখাঁরপুল, গ্রিনরোড, পান্থপথ এলাকার বেশ কিছু ব্লাড ব্যাংক। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল), হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট হাসপাতালের মেয়াদোত্তীর্ণ রক্তে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে মেয়াদোত্তীর্ণ রক্তের বিশাল ব্লাড ব্যাংক সিন্ডিকেট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হুঁশিয়ারি দিয়ে অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও ব্লাড ব্যাংকের তদারকির ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব অবৈধ ব্লাড ব্যাংক থেকে নিয়মিত কমিশন পেতেন হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা। নতুন কোনো ব্লাড ব্যাংক খোলার কথা শুনলেই নিজের নাম ঢুকিয়ে দিতেন কনসালট্যান্ট হিসেবে। শুধু কনসালট্যান্টেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না তারা। ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার তদবির করে নিতেন বড় অঙ্কের কমিশন। এমনকি ব্লাড ব্যাংকে সায়েন্টেফিক রেফ্রিজারেটর ব্যবহারের আইন থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে সাধারণ রেফ্রিজারেটর বিক্রির ঠিকাদারি নিতেন দুজন কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর লাইসেন্স নবায়ন না করেই চলত ব্লাড ব্যাংক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ব্লাড ব্যাংকের কনসালট্যান্ট নিয়োগ সিন্ডিকেটের ঘেরাটোপে আটকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা এসব ব্লাড ব্যাংক থেকে কমিশন সংগ্রহ করে অন্যদের বণ্টন করেন। এমনকি এই সিন্ডিকেটের কনসালট্যান্টদের এলাকা ভাগ করা আছে। যেমন, গ্রিনরোডে এলাকার সব ব্লাড ব্যাংকের কনসালট্যান্ট একজন, পান্থপথে অন্যজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রভাবশালী এ কর্মকর্তাদের কারণে এসব অবৈধ ব্লাড ব্যাংকে কখনো অভিযান পরিচালনা করা হয় না। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশে সক্রিয় এই সিন্ডিকেট। তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত দিয়ে গ্রিনরোড এলাকার বেশ কিছু অবৈধ ব্লাড ব্যাংক চলে। এই মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত রোগীর শরীরে গেলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’ জানা যায়, দেশে প্রতিবছর রক্তের চাহিদা প্রায় ৫ লাখ ব্যাগ। রক্ত নেওয়ার সময় হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া জীবাণু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ করছে অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো। ক্রেতার কাছে রক্ত সরবরাহের সময় ব্যাগের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে মনগড়া রিপোর্ট। শুধু রক্তের গ্রুপ ও ক্রসম্যাচিং পরীক্ষা করেই রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিবিএইচসির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ফারুক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অবৈধ হাসপাতাল, ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন থেকে শুরু করে কেনাকাটা টেন্ডার বাণিজ্যে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এদের সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে স্বাস্থ্য খাতে আর কেউ দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights