শিশুদের স্বপ্নগুলো এখন রঙিন
অনলাইন ডেস্ক
অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা শিশুদের জীবন অন্য শিশুদের থেকে একটু আলাদাই হয়। যে শিশু বুঝতে শেখার পর থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকে, দারিদ্র্যের কষাঘাতে বড় হয়, তার জীবনটা শহুরে কোনো পরিবারের শিশু কিংবা আদরে বেড়ে ওঠা শিশুদের মতো রঙিন হয় না। তাদের স্বপ্নগুলোও ফিকে হয়ে যাওয়া সাদাকালোর মতো দুর্বল। যাতায়াত এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত বেশ দুর্গম চরের এমন সব শিশুকে রঙিন স্বপ্ন দেখাতে এগিয়ে এসেছে বসুন্ধরা শুভসংঘ।
দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় ঝরে পড়া শিশুদের জন্য ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চর আগস্তিতে এমনই একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গত বছর। অতিদরিদ্র পরিবারের যে শিশুগুলো একসময় পড়াশোনা না করে শুধু মা-বাবাকে কাজে সহায়তা করত, তারা এখন সবাই স্কুলে যায়। তারা এখন প্রতিনিয়ত রঙিন স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন দেখেন তাদের মা-বাবারাও। সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করে একজন গর্বিত সন্তানের মা-বাবা হতে এখন স্বপ্নে বিভোর অনেকেই। তাদের সেই স্বপ্নগুলো পূরণের লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করছে টিম বসুন্ধরা শুভসংঘ। গলাচিপা সদর থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে তেঁতুলিয়া নদীর কোল ঘেঁষে চরবিশ্বাস ইউনিয়নের চর আগস্তি গ্রাম।
এলাকাটি সবাই ঘাসির চর নামেই বেশি চেনে। ওয়াপদা বেড়িবাঁধের বাইরে এবং নদীর তীরে হওয়ায় খুব সহজেই জোয়ারের পানি উঠে যায় গ্রামটিতে। চরবিশ্বাস ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই গ্রামের প্রায় ৪০০ পরিবার মূলত মাছ ধরা ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। নিম্ন আয়ের হওয়ায় এখানকার পরিবারগুলোর সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহ খুবই কম। আবার কাছাকাছি ছিল না কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়।
শিক্ষিত করার বুকভরা স্বপ্ন প্রতিটি মা-বাবারই থাকে। কিন্তু স্কুল অনেক দূরে। রাস্তা না থাকায় জোয়ারের পানিতে চরটি প্লাবিত হয় প্রতিনিয়ত। শিশুদেরও আর স্কুলে যাওয়া হয় না। অভিভাবকদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল। পাশাপাশি অতিদরিদ্র পরিবারগুলোরও পাশে দাঁড়িয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। প্রত্যন্ত এই চরের শিশুরাও এখন শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়ে বিকশিত করবে মেধা ও মননকে। যে শিশুরা সাত-আট বছর হলেই বাবার সঙ্গে হয় নদীতে মাছ শিকার করত, নয়তো কৃষিকাজে সহায়তা করত, মায়ের সঙ্গে গৃহস্থালি কাজ করত, তারা এখন স্কুলড্রেস, নতুন জুতা পরে ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায়। এসবের জোগান দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। স্বপ্ন ফিকে হয়ে গিয়েছিল যে শিশুদের, তারা এখন স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে স্কুলে যায়। এসব দেখে আনন্দিত হন অভিভাবকরা।
সাত বছর বয়স হয়ে গেলেও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি সুমাইয়া। গত বছর বসুন্ধরা শুভসংঘের সদস্যরা তার মা-বাবাকে বুঝিয়ে স্কুলে ভর্তি করে নেন। এ বছর সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।
সুমাইয়া বলে, ‘পড়াশুনা কইরা আমি শিক্ষক হমু। আমার এলাকার হগল শিশুগো পড়ামু।’ সুমাইয়ার মতো এমন আরো ৭৬টি পরিবারের দরিদ্র ও পড়াশোনাবিমুখ শিশু বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে পড়াশোনা করে।
শিক্ষার্থী সাহানার মা রুমা বেগম বলেন, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে আমার মাইয়ারে ভর্তি করামু কি না এই নিয়া চিন্তায় আছিলাম। মনে করছিলাম ভর্তি হইতে গেলে টাহা লাগবে। খাতা-কলম আরো নানা জিনিস কিন্না দেওয়া লাগবে। পরে দেহি আমার মাইয়ার জামা, জুতা, ব্যাগ, খাতা, কলম সব দিয়া দেয় হেরাই। এ স্কুলডা না হইলে আমার মাইয়া পড়ানো হইত না। মাইয়াডা আমাগো লগে যহন কয়, মা আমি পড়ালেহা কইরা কলেজে ভর্তি অমু। তহন মনডায় অনেক শান্তি পাই।’
সাহানাজ ও রায়হানের মা শাহিনুর বেগম বলেন, ‘গত বছরও চিন্তা করি নাই আমাগো গেরামে স্কুল হইবে। স্কুলের অভাবে আমাগো গেরামের পোলা-মাইয়ারা পড়ালেহা করতে পারে নাই। বেশির ভাগ মাইয়ারে ১২ বছরের পর বিয়া দিয়া দেওয়া হয়। বোঝেনই তো মাইয়া মানুষ কয় দিন ঘরে রাহোন যায়? আর পোলারা বাহের লগে নৌকায় মাছ ধরে, ক্ষ্যাতে কাম করে। এহন এইহানে পড়ালেহা যদি ভালোভাবে করতে পারে, তাইলে হাই স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিমু। আমাগো পোলা-মাইয়া আর অশিক্ষিত থাকব না।’
আরেক শিক্ষার্থী সামিয়া বলে, ‘আমি পড়ালেহা করে গারমেন্টে (গার্মেন্টস) চাকরি করমু। আমাগো এলাকার সবাইরে ঈদে নতুন নতুন জামা কিন্না দিমু।’
চরবিশ্বাস গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল বলেন, ‘শুরু থেকেই আমি বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল নিয়ে কাজ করছি। এখানকার আরো তিনটি এলাকার শিশুরা সরকারি স্কুল দূরে হওয়ায় এখনো স্কুলে যেতে পারে না। বসুন্ধরা গ্রুপ আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম এলাকার শিক্ষা বিস্তারে যে ভূমিকা রাখছে, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চরবিশ্বাস ইউনিয়নবাসীর পক্ষ থেকে আমরা বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গলাচিপার দুর্গম চরবিশ্বাস ইউনিয়নের চর আগস্তিতে শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল আমাদের দুর্গম এলাকায় শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।’