১০ সেকেন্ডে থেমে গেছে ১৪ বছরের জীবন সংগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

ইদ্রিস মিয়া, বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মেখল ইউনিয়নের খলিপা পাড়ায়। ২০০০ সালে ওমানে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা শাহেদ মিয়াকে হারান। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার এরপর সংসারের হাল ধরতে হয়। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। ২০০৮ সালে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে। সেখান থেকে বাড়তি উপার্জনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২০১৪ সালে সাগরপথে চলে যান গ্রীসে। এরপর ভালোই চলছিলো। কিন্তু গ্রীসের উত্তরাঞ্চলে ১০ সেকেন্ডের ওই ট্রেন দুর্ঘটনায় নিমেষে শেষ হয়ে গেছে ইদ্রিসের সংগ্রাম।

মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়ার (৩১) ছোট দুই ভাই ও এক বোন আছে। তিনি গ্রীসের বিভিন্ন এলাকার মেলাতে শিশুদের খেলনা বিক্রি করতেন। সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশে এসে বিয়ে করেছিলেন। দুর্ঘটনার আগে গত সোমবার তার মা ও মেজো ভাইয়ের সাথে শেষবার মোবাইলে কথা হয়।

গ্রীসের উত্তরাঞ্চলীয় শহর লারিসার কাছে মঙ্গলবার মধ্যরাতে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। এরমধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেনটি রাজধানী এথেন্স থেকে উত্তরাঞ্চলীয় শহর থেসালোনিকি যাচ্ছিলো। গ্রীসে ইদ্রিসের রুমমেট ইকবাল হোসেনের বরাত দিয়ে ইদ্রিসের স্বজনরা জানান, ওই দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী ট্রেনের সামনের বগিতে ছিলো ইদ্রিস।
ইদ্রিসের মেঝো ভাই মোহাম্মদ ইলিয়াস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার নিজের একটি চশমার দোকান আছে। ছোট ভাই জালাল উদ্দিন মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। ছোট বোন বিবাহিত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে ভাই বোনদের নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে অনেক সংগ্রাম করেছেন ইদ্রিস। দুবাই থেকে অবৈধ পথে গ্রীসে গেলেও পরবর্তীতে তিনি গ্রীসের অস্থায়ী গ্রীনকার্ড পেয়েছিলেন। এরমধ্যে তিনবার দেশে এসেছিলেন। স্থায়ী গ্রীনকার্ড পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এরমধ্যেই এই দুর্ঘটনা সব কেড়ে নিলো।

ইদ্রিসের মা রওশন আরা ওমানের মাটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় যখন স্বামীকে হারান তখন বড় ছেলে ইদ্রিসের বয়স মাত্র এগারো বছর। দীর্ঘ সময় তিনি সন্তানদের বড় করতে সংগ্রাম করেছেন। সংসারে যখন সুখ আসার সময় হয়েছে তখন বড় ছেলেকেও হারালেন। তাও বিদেশের মাটিতে সড়ক দুর্ঘটনায়। স্বামীর পর সন্তানকেও একইভাবে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন মধ্যবয়সী এই নারী। শনিবার তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শোকের মাতম চলছে। অনেকক্ষণ নির্বাক থাকার পর মাঝে মাঝে বিলাপ করছিলেন রওশন। সন্তানের লাশটা যেনো শেষবারের মতো দেখতে পান, এটাই ছিলো তার আকুতি।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাতে গ্রীসের উত্তরে সাড়ে তিনশো যাত্রী বহনকারী একটি ট্রেনের সাথে মালবাহী একটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে এখনো পর্যন্ত অন্তত ৫৭ জন মারা গেছেন। দেশটির ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এই ট্রেন দুর্ঘটনা কি কারণে ঘটেছে সেটা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এই ঘটনায় দেশটিতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির পরিবহন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে স্থানীয় স্টেশন মাষ্টারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য রেল শ্রমিকরা সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করে রাজধানী এথেন্সে আন্দোলন করছেন। নিহতদের ডিএনএ সংগ্রহ করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে দেশটির প্রশাসন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights